মাদারীপুর জেলা কিসের জন্য বিখ্যাত
দেশের সকল জেলা তার নিজ নিজ স্বকীয়তা আর বৈশিষ্টে সমুজ্বল হয়ে এই বাংলার বুকে একে চলেছে সাফল্যের স্বাক্ষর। সেই ধারাবাহিকতায় পেছনে পড়ে নেই মাদারীপুর। চলুন বন্ধুরা তাহলে জেনে নেয়া যাক “মাদারীপুর জেলা কিসের জন্য বিখ্যাত”।
মাদারীপুর দেশের একটি ইতিহাস সমৃদ্ধ প্রাচীন শহর। পঞ্চদশ শতাব্দীর ধর্মীয় সাধক হযরত বদরুদ্দিন শাহ্ মাদার (র.) এর নামানুসারে এই জেলার নামকরণ করা হলেও অতি প্রাচীনকালে মাদারীপুরের নাম ছিল ইদিলপুর।
প্রাচীনকাল থেকে নানা ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্য দিয়ে বয়ে এসেছে আজকের এই মাদারীপুরের ইতিহাস।
মাদারীপুরের ইতিহাস ও ঐতিহ্য
কোটালীপাড়া ও মদনপাড়ায় বিশ্বরূপ সেন এবং ইদিলপুরে কেশব সেনের পান্ডুলিপি পাওয়া যায়। প্রাচীনকালে মাদারীপুরের পূর্বাংশ ইদিলপুর এবং পশ্চিম অংশ কোটালীপাড়া নামে পরিচিত ছিল। সেন রাজাদের পতনের পর চন্দ্রদ্বীপ রাজ্য প্রতিষ্ঠিত হয়। বরিশাল বিভাগ, মাদারীপুর, শরীয়তপুর, গোপালগঞ্জ ও বাগেরহাট জেলা চন্দ্রদ্বীপ রাজ্যের অধীনে ছিল।
চতুর্দশ শতকে ফরিদপুর সুলতানদের শাসনাধীনে চলে যায়। ১২০৩ থেকে ১৫৭৫ সাল পর্যন্ত সুলতানগণ বাংলা শাসন করে। কিন্তু পূর্ববঙ্গে প্রায় একশ বছর সেন রাজত্ব চলে। সুলতান রুকনউদ্দীন বরবক শাহ (১৪৫৯-১৪৭৪ খ্রি.) প্রথম ফরিদপুর-চন্দ্রদ্বীপ দখল করেন। সুলতান জালাল উদ্দিন ফতেহ শাহ (১৪৮১-১৪৮৫ খ্রিঃ) ফরিদপুর ও চন্দ্রদ্বীপের একাংশ দখল করে ফতেহাবাদ পরগনা গঠন করেন।
ফরিদপুর মাদারীপুরের প্রথম ঐতিহাসিক নাম ফতেহাবাদ। সুলতান হুসেন শাহ (১৪৯৩-১৫১৯ খ্রিঃ) ফতেহাবাদের জনপ্রিয় শাসক ছিল। ১৫৩৮ হতে ১৫৬৩ সাল পর্যন্ত শেরশাহ ও তার বংশধরগণ বাংলা শাসন করেন। ১৫৬৪ সাল হতে ১৫৭৬ সাল পর্যন্ত কররানি বংশ বাংলার রাজত্ব করে তারপর ১৫৭৬ সাল হতে ১৬১১ সাল পর্যন্ত বার ভূঁইয়ার অধীনে ছিল বাংলা।
বার ভূঁইয়াদের অন্যতম ছিল ফরিদপুরের চাঁদ রায়, কেদার রায় এবং বাকলার রামচন্দ্র রায়। মোগল ও নবাবী শাসন চলে ১৭৬৫ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত। তারপর বাংলা ইংরেজদের দখলে চলে যায়। মাদারীপুর জেলা ১লা মার্চ, ১৯৮৪ খ্রিস্টাব্দ সৃষ্টি হয়। এ জেলার আয়তন ১১৪৪.৯৬ বর্গ কি.মি., নির্বাচনী এলাকা মাদারীপুর-১ (২১৮), মাদারীপুর-২ (২১৯), মাদারীপুর-৩ (২২০)।
মাদারীপুরের জেলার পরিসংখ্যন
জেলার মোট ভোটার সংখ্যা ৬,৭৩, ৫৯১। পুরুষ ভোটার সংখ্যা ৩৩৩৪৭৮ হলেও নারী ভোটার সংখ্যা কিন্তু কম নয়। সেই সংখ্যা ৩৪০১১৩ জন। জেলার মোট জনসংখ্যা ১২,১২,১৯৮ জন (আদমশুমারি ও গৃহগণনা, ২০১১)। এই জেলার উপজেলার সংখ্যা ৪ টি হলেও থানা ৫ টি। ৪ টি পৌরসভায় ইউনিয়ন মোট ৫৯ টি যেখানে গ্রামের সংখ্যা ১০৬২ টি আর মৌজা ৪৭৯ টি।
একটি জেলাক স্বরণীয় করে রাখতে কোন না কোন প্রাচীন স্থাপনা বা আলোচিত ঘটনার প্রয়োজন হয়। সেই দৃষ্টিকোণ থেকে ইতিহাস নির্ভর এই জেলা সর্ম্পনটাই বিচিত্রতার দাবিদার। তাহলে নিজেই জেনে নিন মাদারীপুর জেলা কিসের জন্য বিখ্যাত।
হযরত শাহ মাদারের দরগাহ
আড়িয়াল খাঁ নদীর তীর ঘেঁষে মাদারীপুর শহরের একপ্রান্তে হযরত শাহ মাদারের দরগাহ অবস্থিত। কে এই দরগাহ নির্মাণ করেছে তা সুনির্দিষ্টভাবে জানা যায় না। দরগাহের সাথে বর্তমানে একটি মসজিদ ও একটি মাদ্রাসা রয়েছে।
কাজী বাড়ি মসজিদ
মাদারীপুর জেলার অন্যতম প্রাচীন মসজিদ আলগী কাজী বাড়ি মসজিদ। মাদারীপুর সদর উপজেলার বাহাদুরপুর ইউনিয়নে আলগী গ্রামে এর অবস্থান। আজ থেকে প্রায় ৩শ বছর পূর্বে আলগী দিঘির পাড়ে এ মসজিদ নির্মাণ করা হয়। অনেকের ধারণা আরব দেশ থেকে আগত কোনো এক দ্বীন প্রচারক দরবেশ বা আওলিয়া এটি নির্মাণ করেন।
রাজারাম মন্দির
রাজারাম মন্দির মাদারীপুর জেলার প্রাচীনতম মন্দির। এ মন্দিরটি জেলার রাজৈর উপজেলার খালিয়া গ্রামে অবস্থিত। খালিয়ার বিশিষ্ট হিন্দু জমিদার রাজারাম রায় সপ্তদশ শতাব্দিতে এটি নির্মাণ করেন। এ মন্দিরের সম্মুখভাগ টেরা কোটা কারুকার্য মন্ডিত এবং রামায়ণ-মহাভারতের দৃশ্যাবলী খচিত।
ঝাউদি গিরি
মাদারীপুরের ইতিহাস ও ঐতিহ্য মাদারীপুর সদর উপজেলার ঝাউদিতে অবস্থিত এ গিরিকে এ জেলার সবচেয়ে প্রাচীন প্রত্নসম্পদ বলে ধারণা করা হয় । ব্রিটিশ যুগের বহু পূর্বে এটি নির্মিত। স্থানীয় বাসিন্দাদের মতে মঘ বংশের লোকেরা ইহা নির্মাণ করে। ইট-সুড়কি গাথুনির ওপর ১শ ফুটের অধিক উঁচু এ গিরিটির উল্লেখ আর এস ও সি.এস ম্যাপে এর অবস্থান থাকায় জরীপ কাজে এটি ব্যবহৃত হয়ে আসছে। এই নির্মাণের জানা যায়নি।
আউলিয়াপুর নীলকুঠি
আউলিয়াপুর নীলকুঠি এ জেলার অন্যতম দর্শনীয় স্থান। মাদারীপুর সদর উপজেলার ছিলারচর ইউনিয়নের আওলিয়াপুর গ্রামে এ নীলকুঠি অবস্থিত। অত্যাচারী ইংরেজ নীলকর ডানলপ ছিলেন এ কুঠির অধিকর্তা। এ কুঠির অদূরে ফরায়েজী আন্দোলনে নেতা হাজী শরীয়ত উল্লাহর অনুসারীদের সাথে নীলকর ডানলপ বাহিনীর যুদ্ধ বাধে। সে যুদ্ধে ডানলপের বাহিনী চরম পরাজয় বরণ করে। ঐ স্থানটি রণখোলা নামে পরিচিত।
মিঠাপুর জমিদার বাড়ি
মাদারীপুর সদর উপজেলায় অবস্থিত ঐতিহ্যবাহী মিঠাপুর জমিদার বাড়ি। মুসলমান জমিদার গোলাম মাওলা চৌধুরী ও গোলাম ছত্তার চৌধুরী এবং তাদের বংশধর আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন রাষ্ট্রবিজ্ঞানী প্রফেসর জি. ডাব্লু চৌধুরীর বাড়ি হচ্ছে এ জমিদার বাড়ি। হিন্দু জমিদার লক্ষ্মী নারায়ন সিকারের বাসস্থানও মিঠাপুরে। তাদের নির্মিত দালান-কোঠা এখানে এখনও বিদ্যমান। এগুলো এ জেলার অন্যতম প্রত্নসম্পদ।
প্রণব মঠ
রাজৈর উপজেলার বাজিতপুরে ঢাকা-বরিশাল মহাসড়কের পাশে প্রণবমঠ অবস্থিত। প্রণবস্বামী প্রণবানন্দ মহারাজের নাম অনুসারে এ প্রণব মঠ। এখানে তাঁর প্রতিষ্ঠিত একটি আশ্রম আছে। স্বামী প্রণবানন্দ মহারাজ ছিলেন অগ্নিযুগের একজন বিশিষ্ট বিপ্লবী এবং বীর সাধক। মঠটি বেশ প্রাচীন। অন্যতম একটি প্রাচীন মঠ। মঠ এলাকায় বাজার গড়ে ওঠায় এর নাম হয়েছে মঠের বাজার। ধনীরাম মাঝির পুত্র ডেংকর মাঝি এটি নির্মাণ করেন।
শান্তিকেন্দ্র
ঢাকা থেকে ২৫০ কি.মি. দক্ষিণ-পশ্চিমে মাদারীপুর জেলার অন্তর্গত রাজৈর উপজেলার খালিয়া ইউনিয়নে শান্তিকেন্দ্র প্রতিষ্ঠিত। এই ক্যাম্পাসে ৩ টি পুকুর, ফলের বাগান এবং একটি পুরোনো মন্দির রয়েছে। শান্তিকেন্দ্র গ্রামীণ জনগোষ্ঠির কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত।
পর্বতের বাগান
মাদারীপুরের ইতিহাস ও ঐতিহ্য মাদারীপুর সদর উপজেলার মস্তফাপুর ইউনিয়নে কুমার নদীর দক্ষিণ তীর ঘেঁষে পর্বতের বাগান অবস্থিত। পর্বতের বাগান এ জেলার অন্যতম পিকনিক স্পট। ষাট বছর আগে ২৬ একর জমিতে রাজ বিহারী পর্বত এ বাগানটি গড়ে তোলেন। শত শত প্রজাতির গাছপালা, পুকুর-দিঘি ও অতিথি পাখির কলকাকলিতে এক সময় প্রাণবন্ত ছিল এ বাগান।
শকুনীলেক
মাদারীপুর শহরের কেন্দ্রে অবস্থিত শকুনীলেক এ জেলার অন্যতম আকর্ষণীয় জলাধার। ১৯৪৩ সালে এ লেক খনন করা হয়। এ লেকের আয়তন প্রায় ২০ একর। লেকের উত্তর পাড় ঘিরে রয়েছে পুরাতন কালেক্টরেট ভবন, পুলিশ সুপারের কার্যালয়, শহীদ স্মৃতিসৌধ, শহীদ মিনার এবং দক্ষিণ পাড়ে সার্কিট হাউস ও মুক্তিযোদ্ধা মিলনায়তন। লেকের পূর্বপাড়ে রয়েছে জেলা কারাগার ও মাদারীপুর সদর হাসপাতাল এবং পশ্চিম পাড়ে ডিসি একাডেমী ও জেলা সদর জামে মসজিদ।
চরমুগরিয়া বন্দর
কালকিনি উপজেলার আমড়াতলা ও খাতিয়াল গ্রামের মধ্যবর্তী স্থানে এ দিঘি অবস্থিত। আয়তন ২৫ একর। মোগল সম্রাট জাহাঙ্গীরের শাসন আমলে সুবাদার ইসলাম খাঁর নেতৃত্বে সৈন্যের বিশাল এক বাহিনী ঢাকা যাওয়ার সময় এখানে কিছুদিন অবস্থান করেন। তাদের পানির অভাব মেটাতেই এ দিঘি খনন। এক সময় বিখ্যাত ব্যবসা কেন্দ্র হিসেবে পরিচিত ছিল চরমুগরিয়া। এ ছাড়াও খেলাধুলা, সাহিত্য-সংস্কৃতি চর্চার কেন্দ্র ছিল এটি। চরমুগরিয়ার সেই ঐতিহ্য এখন বিলুপ্তির পথে। নীরব সাক্ষী দাঁড়িয়ে থাকা এ বন্দরের বিশেষত্ব হলো এখানকার বানর। মানুষের বসতির পুর্বেই এখানে তাদের বসবাস।
আজকে আপনাদের সামনে “মাদারীপুর জেলা কিসের জন্য বিখ্যাত” সেই সম্বন্ধে তুলে ধরতে পেরে আমরা আনন্দিত। সেই সাথে আপনারা আমাদের সাথে থাকায় আমাদের প্রচেষ্টা স্বার্থক হতে চলেছে।