দক্ষিণ ভারতের রাজ্য কেরালার বাসিন্দা উমরউদ্দিন শামিরের বিয়ে হয়েছিল মাত্র নয় মাস আগে। কুয়েতে এক ভারতীয় তেল কোম্পানিতে গাড়িচালক ছিলেন শামির।
বুধবার ভোররাতে কুয়েত সিটির দক্ষিণে আল-মাঙ্গাফ নামের একটি বহুতল আবাসনে আগুন লেগে যে অন্তত ৪২ জন ভারতীয়র মৃত্যু হয়েছে, উমরউদ্দিন শামির তাদেরই একজন।
ওই অগ্নিকাণ্ডে এখনো পর্যন্ত মারা গেছেন অন্তত ৪৯ জন, আহত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি রয়েছেন অন্তত ৩০ জন।
কেরালার কোল্লাম জেলায় ২৯ বছর বয়সী উমরউদ্দিন শামিরের বাড়িতে ওই মর্মান্তিক খবর এসে পৌঁছানোর পর থেকে পরিবারের কেউ কথা বলার অবস্থায় নেই।
তাই বিবিসি যখন ওই পরিবারের নম্বরে ফোন করে, সেটা তুললেন এক প্রতিবেশী। নয় মাস আগে বিয়ে হয়।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ওই প্রতিবেশী বিবিসিকে বললেন, ‘কয়েক ঘণ্টা আগেই মাত্র খবর এসেছে। পরিবারের কেউই এখন কথা বলার মতো অবস্থায় নেই। মাত্র নয় মাস আগে উমরউদ্দিন দেশে এসেছিল বিয়ে করতে।’
কুয়েতে উমরউদ্দিনের বন্ধু নৌফাল বিবিসি হিন্দিকে জানিয়েছেন, ‘ওর পরিবার সম্পর্কে আমি খুব বেশি কিছু জানি না। ওদের বিল্ডিংয়ের থেকে তিনটি বাড়ি পরে আমার বাসা। আমরা সবাই একই তেল কোম্পানিতে চাকরি করি। আগুন লাগার সময়ে ভবনটিতে কে ছিল আর কে ছিল না, তা বলা খুব কঠিন।
‘তেল কোম্পানিতে আমরা যারা কাজ করি, তাদের শিফট ডিউটি থাকে। সাতজনের একটি দল খুব ভোরে, সম্ভবত রাত দেড়টা নাগাদ কাজে গিয়েছিল। তারা ফিরে এসে এই ঘটনা দেখতে পায়,’ বলছিলেন নৌফাল।
নৌফাল জানাচ্ছিলেন যে- ওই ভবনটিতে বসবাসকারী বেশির ভাগ মানুষই ভারতের, বিশেষ করে কেরালা ও তামিলনাড়ু থেকে আসা মানুষ। তবে অন্যান্য দেশের লোকজনও সেখানে বসবাস করত।
জানালা দিয়ে লাফ দিয়ে বেঁচেছি
আগুন লাগার পরে ঘটনাস্থলে গিয়েছিলেন কোনেত্তু।
তিনি বলছিলেন, ‘বেসমেন্ট থেকে আগুন ছয়তলা ভবনে ছড়িয়ে পড়েছিল। আমরা অনেক লাশ শনাক্ত করতে পারিনি। কিছু লাশ শনাক্ত করতে ডিএনএ পরীক্ষা করার দরকার হতে পারে।’
তামিলনাড়ুর বাসিন্দা মণিকন্দন কুয়েতে শ্রমিকের কাজ করেন। অগ্নিকাণ্ড নিয়ে বিবিসি তামিলের সাথে কথা বলেছেন তিনি।
‘যেখানে আগুন লেগেছে তার কাছেই একটি অ্যাপার্টমেন্টে থাকি আমি। যেহেতু গ্রীষ্মকাল, তাই বেশিরভাগ শ্রমিক রাতের শিফটে কাজ করেন’।
রাতের শিফট শেষে ভোরে ফিরে এসে কয়েকজন শ্রমিক রান্না করছিলেন। আগুন লাগার সাথে সাথে তা দ্রুত ছড়িয়ে পড়তে শুরু করে।
ওই বাড়িটিতে যারা ছিলেন, তাদের পক্ষে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব ছিল না। ভোররাত নাগাদ যখন আগুন লাগে তখন অনেকে ঘুমিয়ে ছিলেন।
‘ওই বাড়িটিতে যারা থাকেন তাদের কাউকে আমি ব্যক্তিগতভাবে চিনি না, তবে আগুনের মধ্যেই অনেককে দেখেছি দম বন্ধ হয়ে মারা যেতে,’ বলছিলেন মনিকন্দন।
ওই বাড়ি থেকে জীবিত উদ্ধার করা হয়েছে, এমন এক শ্রমিক জানিয়েছেন, ‘আমি পাঁচ তলায় ঘুমোচ্ছিলাম। হঠাৎই প্রতিবেশীরা দরজায় ধাক্কা দেয়। বাইরে বেরিয়ে কালো ধোঁয়া ছাড়া আর কিছুই দেখা যাচ্ছিল না।
‘যারা আমার দরজায় কড়া নাড়ে, তারা প্রাণ বাঁচাতে অন্য দিকে সরে যায়, তাই আমরা অন্য কোনো ঘরের দরজায় ধাক্কা দেয়া যায়নি। আমার ঘরের জানালাটা বেশ বড় ছিল। আমরা চারজনই ওই ঘরে থেকে গিয়েছিলাম। জানালা দিয়ে লাফ দিয়ে বেঁচেছি। আমার পাশের ঘরের জানালাটা ছোট ছিল তাই তারা বের হতে পারেনি।’
দেশে ফেরার কথা ছিল
কুয়েতের অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় যেসব ভারতীয় মারা গেছেন, তাদের অধিকাংশই কেরালার বাসিন্দা
ওই সব পরিবারগুলো এখন শোকে পাথর হয়ে গেছে। কয়েকটি পরিবার এবং স্থানীয়দের সাথে কথা বলতে পেরেছে বিবিসি।
ম্যাথ্যু লুকোসে কুয়েতের সংস্থা এনবিটিসির ফোরম্যান ছিলেন। কেরালায় তার পরিবার এ ঘটনার কথা জানতে পারে টিভির সংবাদ দেখে। লুকোসের বাবা-মা বয়স্ক। মায়ের বয়স ৮৬ বছর এবং বাবার ৯৩ বছর।
তিনি গত বছর কেরালাতেই ছিলেন এবং দ্রুত কুয়েত থেকে ফিরে আসার পরিকল্পনা করেছিলেন। লুকোসের স্ত্রী ও সন্তানরা শোকে একরকম পাথর হয়ে গেছেন। সমানে কান্নাকাটি করছেন তারা। লুকোসেই বাড়ির একমাত্র উপার্জনকারী ছিলেন।
লুকোসের ছোট ভাই বিবিসি হিন্দিকে বলেন, ‘গত ১৮ বছর ধরে কুয়েতে এনবিটিসি কনস্ট্রাকশন কোম্পানিতে কাজ করছিল ও। ওর এক মেয়ে একাদশ শ্রেণিতে এবং অন্য মেয়ে পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ে। আমরা টিভি থেকে খবর পাই এই ঘটনার। ওর কাঁধেই ছিল পুরো সংসারের দায়িত্ব। যে বাড়িটিতে আগুন লেগেছে, আমিও সেখানে গেছি। দু’বছর আগেও আমিও ওখানে কাজ করতাম, ভাইয়ের সাথে দেখা করতে যেতাম।’
কেরলের কোট্টায়ামের ২৯ বছরের স্টেফিন সাবুর পরিবারেরও একই পরিস্থিতি। তার বাবা অসুস্থ, মা কথা বলার মতো অবস্থায় নেই।
স্থানীয় গির্জার সদস্য বাবু ম্যাথু বলেন, ‘আমরা সারা রাত ওদের পরিবারের সাথেই ছিলাম। আগামী মাসে স্টেফিনের দেশে আসার কথা ছিল। এই বাড়িটি ওই বানিয়েছিল, পরের মাসে গৃহপ্রবেশ করার কথা ছিল তার।’
মালিককে গ্রেফতারের নির্দেশ
কুয়েতের স্থানীয় সংবাদমাধ্যম বলছে অভ্যন্তরীণ বিষয়ক মন্ত্রী শেখ ফাহাদ আল-ইউসুফ আল-সাবাহ মঙ্গাফের অগ্নিদগ্ধ ভবনটির মালিককে গ্রেফতারের নির্দেশ দিয়েছে। একই সাথে ভবনটির মিশরীয় নিরাপত্তারক্ষীকেও আটক করার কথা বলেছে প্রশাসন।
বলা হচ্ছে যে- ওই ভবনটিতে ১৬০ জন বাস করতেন। এই বাড়িটির মালিকের সংস্থাতেই কাজ করতেন এই শ্রমিকরা, এমনটাও বলা হচ্ছে।
শেখ ফাহাদ ঘটনাস্থল পরিদর্শন করার পরে জানান, ‘আজ যা হয়েছে, সব কিছুর পেছনে দায়ী ওই সংস্থাটি আর ভবনের মালিক। তাদের লোভের ফলেই এই ঘটনা হয়েছে।’
একটি ভবনে বহু সংখ্যক শ্রমিককে ঠাসাঠাসি করে রাখার মতো বেআইনি কাজ কোথায় হচ্ছে, তা খতিয়ে দেখে ভবিষ্যতে যাতে এধরনের দুর্ঘটনা এড়ানো যায়, সেই ব্যবস্থা করতে স্থানীয় প্রশাসনকে নির্দেশ দিয়েছেন ফাহাদ।
কুয়েত পৌঁছেছেন ভারতের মন্ত্রী
ভারতের পররাষ্ট্র বিষয়ক রাষ্ট্রমন্ত্রী কীর্তি বর্ধন সিং বৃহস্পতিবার সকালে কুয়েতে পৌঁছেছেন। সেখানে তিনি সাংবাদিকদের জানিয়েছেন যে নিহতদের মধ্যে ৪২-৪৩ জনই ভারতীয়।
তিনি এও জানিয়েছেন যে নিহতদের শনাক্ত করার জন্য ডিএনএ পরীক্ষা করানো হচ্ছে এবং বিমান বাহিনীর একটি বিমান অপেক্ষা করছে দেহগুলো দেশে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য।
আবার কেরালার অনেক শ্রমিক যেহেতু এই ঘটনায় মারা গেছেন, তাই কুয়েতের উদ্দেশে রওনা হচ্ছেন সেখানকার স্বাস্থ্যমন্ত্রী ভিনা জর্জের নেতৃত্বে কয়েকজন অফিসার।
কেরালা সরকার এবং কেন্দ্রীয় সরকার পৃথকভাবে নিহত ও আহতদের পরিবারগুলোর জন্য আর্থিক সহায়তার কথা ঘোষণা করেছে।
অন্যদিকে কোনো এশীয়, বিশেষত ভারত, পাকিস্তান, বাংলাদেশ বা নেপালের নাগরিক মধ্যপ্রাচ্যে কাজে গিয়ে মারা গেলে যিনি লাশ দেশে পাঠানোর ব্যবস্থা করে থাকেন বিনা খরচে, সেই আশরাফ থামারাসারি বিবিসিকে জানিয়েছেন যে- শুক্রবার তিনি কুয়েত যাচ্ছেন নিহতদের স্বজনদের অনুরোধে। সেখান থেকে লাশ দেশে পাঠানোর ব্যবস্থায় সহায়তা করবেন তিনি।
গত আড়াই দশকে কয়েক হাজার ভারতীয়-বাংলাদেশী-পাকিস্তানি মানুষের লাশ তিনি হাসপাতাল-মর্গ-প্রশাসনিক ব্যবস্থাপনা করে দেশে পাঠিয়েছেন কেরালার আদি বাসিন্দা থামারাসারি।
যাদের লাশ তিনি দেশে পাঠিয়েছেন, তাদের মধ্যেই ছিলেন হিন্দি সিনেমার সুপারস্টার শ্রীদেবীর লাশও।
সূত্র : বিবিসি