পাহাড়ি কন্যা বান্দরবান কিসের জন্য বিখ্যাত
বাংলাদেশের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের তুলনা নেই।এখানে হয়ত হিমালয়ের মত বিশাল পর্বত,নায়াগ্রার মত উঁচু জলপ্রপাত, বরফ বা মরুভূমির মতো বালু নেই।কিন্তু এদেশের যে সাধারণ সৌন্দর্য আছে তাই এদেশকে করেছে অসাধারণ সুন্দর ।
বাংলাদেশের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের অন্যতম অংশ হল এদেশের পাহাড়ি অঞ্চল। দেশের দক্ষিণ দিকে রয়েছে পাহাড়ি জেলা।এর মধ্যে বান্দরবান জেলা অন্যতম। এ জেলাটিকে সবাই পাহাড়ি কন্যা নামে চিনি।
কারণ এখানে বিভিন্ন উচ্চতার অনেক পাহাড় রয়েছে।এখানকার মানুষগুলোর জীবনধারার অনেক কিছুই পাহাড়কেন্দ্রিক।বাংলাদেশের পর্যটনের মুল আকর্ষণ এই বান্দরবান।কারণ এখানকার পাহাড়ি ঝর্ণা, লেক,নদী,পাহাড়, মেঘ, ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীদের দেখতে দূর দূরান্ত থেকে মানুষ চলে আসে।চলুন আজকে জানব পাহাড়ি কন্যা বান্দরবান কিসের জন্য বিখ্যাত।
বান্দরবান সম্পর্কে কিছু তথ্য
বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্বদিকের একটি জেলা হল বান্দরবান।১৯৮১ সালে বান্দরবান স্বাধীন বাংলাদেশের পার্বত্য জেলা হিসেবে স্বীকৃতি পায়। খুবই কম জনসংখ্যার বসবাস এই প্রত্যন্ত জেলাটিতে।সীমান্তবর্তী এ জেলার অদূরে পার্শ্ববর্তী দেশ মায়ানমার।
বান্দরবান নামের পেছনে আছে একটি মজার রূপকথার গল্প।স্থানীয় এলাকাবাসীদের মতে,এখানে পূর্বে অনেক বানর ছিল।তারা শহরের প্রবেশপথে পাহাড়ে লবণ খেতে আসত।কিন্তু অতিবৃষ্টির কারণে পানি বেড়ে যাওয়ায় তারা লবণ খাওয়ার জন্য একে অপরের হাত ধরে সারি বেধে পার হয়।বানরদের লবণ খেতে পানির রাস্তা পার হওয়ার এ বিস্ময়কর দৃশ্য দেখে ঐ সময়ের জনপদের কাছে এ এলাকা বান্দরবান নামে পরিচিতি পায়।
এ জেলার আছে ৭ টি উপজেলা,৭ টি থানা ও ২ টি পৌরসভা।সাঙ্গু, মাতামুহুরি বাঁকখালি নামে ৩ টি নদী রয়েছে।
কিন্ত পাহাড়ি কন্যা বান্দরবান কিসের জন্য বিখ্যাত এরকম প্রশ্নের উত্তরে এ জেলাটিকে এককভাবে কোন বিশেষ জিনিসের জন্য বিখ্যাত বলা যায় না।যেহেতু এর পাহাড়,নদী,ঝর্ণা তথা প্রকৃতি সবচেয়ে আকর্ষণ করে মানুষকে তাই বলব বান্দরবান এর প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের জন্য বিখ্যাত।
বাংলাদেশের বান্দরবান জেলা হিল জুস এবং তামাক এর জন্য এই জেলা দেশ জুড়ে বিখ্যাত। এছাড়াও বান্দরবান জেলার দর্শনীয় স্থান এর জন্য ও বিখ্যাত।
বান্দরবান জেলার দর্শনীয় স্থান
১/ বগা লেক:
বগা লেক বান্দরবানের সুন্দর একটি প্রাকৃতিক হ্রদ। এটি বগাকাইন লেক বা বগা লেক নামেও পরিচিত। বান্দরবানের রুমা সদর উপজেলা থেকে ১৮ কিলোমিটার দূরে বগা হ্রদ অবস্থিত। এ লেকের আয়তন প্রায় ১৫ একর। বগা হ্রদ বাংলাদেশের সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে প্রায় ৩০০০ ফুট উঁচু। বগা হ্রদের জলের রঙ নীল এবং খুব চোখ ধাঁধানো। বগা হ্রদ সৃষ্টির পেছনে রয়েছে অনেক পৌরাণিক কাহিনী।
প্রথমে আপনাকে বান্দরবান থেকে রুমা উপজেলায় যেতে হবে “চান্দের গাড়ি” (পাবলিক জীপ) বা ব্যক্তিগত গাড়িতে করে। রুমা থেকে বগা লেক পর্যন্ত পাবলিক জীপ ভাড়া করা যায়। পথে আপনাকে সংশ্লিষ্ট নিরাপত্তা ক্যাম্পে আপনার নাম, যোগাযোগের ঠিকানা এবং অন্যান্য বিবরণ নিবন্ধন করতে হবে। বিকাল ৪টার পর রুমা থেকে বগা লেকের উদ্দেশ্যে রওনা হওয়ার অনুমতি নেই।
২/ নীলগিরি :
নীলগিরি বাংলাদেশের সর্বোচ্চ পর্যটন স্পট। এটি প্রায় ২২০০ ফুট উঁচু এবং বান্দরবান সদর থেকে মাত্র ৪৫ কিলোমিটার দূরে থানচি উপজেলায় অবস্থিত। এই নীলগিরি বান্দরবানের আর্মি ব্রিগেড দ্বারা পরিচালিত। এই স্পটটির পাশে আপনি ম্রো সম্প্রদায়ের গ্রামগুলি দেখতে পাবেন। তাদের রঙিন সংস্কৃতি এবং জীবনযাত্রার ধরন অবশ্যই আপনার কাছে একটি ব্যতিক্রম অভিজ্ঞতার তৈরি করবে। বর্ষাকালে পুরো জায়গাটাই মেঘের চাদরে ঢেকে যাওয়ার ফলে এখানে এক মনোরম দৃশ্যের সৃষ্টি হয়। আপনি মেঘের মধ্যে ভেসে বেড়াবেন।হাত দিয়ে মেঘ ধরতে যাবেন কিন্তু পারবেন না।
শীতের মৌসুমে ক্যাম্প ফায়ারের জন্য এটি একটি চমৎকার জায়গা। এখানকার মেঘের কুয়াশাচ্ছন্ন অভিজ্ঞতা কয়েক দশক ধরে আপনার স্মৃতিতে অম্লান থাকবে। গ্রীষ্মে ঝকঝকে সূর্যোদয় এবং সূর্যাস্ত এতটাই নজরকাড়া যে এখানে আসার মূল উদ্দেশ্যই হয় এটা দেখা। সবুজ পাহাড়কে আলোকিত করে পাহাড়ের নীচ থেকে সূর্য উদিত হচ্ছে এবং অস্তও যাচ্ছে। এখান থেকে আপনি সাঙ্গু নদী ও বগালেকের সৌন্দর্যও উপভোগ করতে পারেন।
৩/ চিম্বুক :
চিম্বুক পাহাড় বান্দরবানের আরেকটি বিখ্যাত স্থান।এ জায়গাটিকে বাংলার দার্জিলিংও বলা হয়।কারণ পাহাড়টির চূড়ায় আছে মেঘের মেলা।
চিম্বুক বাংলাদেশের তৃতীয় সর্বোচ্চ পর্বত।এ পাহাড়টির গায়ে তৈরি করা হয়েছে রাস্তা যা দিয়ে চূড়ায় পৌঁছানো যাবে।আর চূড়াটিকেও সাজানো হয়েছে পরিপাটি ও পরিকল্পিতভাবে। পাহাড়ের চূড়ায় উঠতে হলে স্থানীয় জীপ ( চান্দের গাড়িতে) উঠতে হবে,তবে অন্যান্য বাহনও উঠতে পারবে।গাড়িতে করে চিম্বুকের চূড়ায় যাওয়ার পথে সবুজ পাহাড়, বনরাজি আর আঁকাবাকা রাস্তা বেয়ে উপরে ওঠার দৃশ্যও এত সুন্দর যে এটা দেখতেও মানুষ এখানে আসে।আর পাহাড়ের চূড়ায় স্থানীয় ফল বিক্রেতাদের কাছ থেকে বান্দরবানে জন্মানো সুস্বাদু পেঁপে, আনারস,কমলা,কলা ইত্যাদি না খেয়ে আসবেন না।
আর চূড়ায় আছে নব চত্বর নামে বিশাল এক চত্বর।সাথে কাছাকাছি মেঘ দেখার সুযোগ তো আছেই।এ পাহাড় থেকে কক্সবাজারের সাগর ও চট্টগ্রামের বিভিন্ন জায়গা দেখা যায়।
৪/ কেওক্রাডং:
বাংলাদেশ ও মায়ানমার সীমান্তে অবস্থিত বাংলাদেশের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ পর্বত হলো কেওক্রাডং পর্বত।প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরপুর হলেও এ পর্বতটি দূর্গম এলাকায় অবস্থিত। অনেক এডভেঞ্চারপ্রিয় মানুষ শীতে এখানে আসেন।সবুজ কেওক্রাডংয়ের মনোমুগ্ধকর সৌন্দর্য, শীতল ঝর্ণা, আঁকাবাঁকা পাহাড়ি রাস্তার ধার আর পাহাড়ের চূড়ায় মেঘের লুকোচুরির খেলা দেখে আপনি মুগ্ধ হবেন।
৫/ তাজিংডং:
বান্দরবানের বিখ্যাত আরেকটি পাহাড় হল তাজিংডং বা “বিজয়” যা বাংলাদেশের সর্বোচ্চ পর্বত। তাজিংডং পাহাড় প্রায় ৭৯০ মিটার উঁচু ।
তাজিংডং দুর্গম এলাকায় হওয়ায় আগে এখানে পৌঁছানো কষ্টসাধ্য ছিল। তবে এ অবস্থার কিছুটা পরিবর্তন হওয়ায় বর্তমানে প্রচুর পর্যটক তাজিংডং এর সৌন্দর্য উপভোগ করতে ভীড় করে । বিশেষ করে যারা ট্রেকিং করেন তারা এখানে আসেন।কারণ পাহাড় বেয়ে ওঠার স্বাদ নিতে এ পাহাড় অন্যতম জায়গা।পাহাড়ি রাস্তাগুলো বেয়ে বাস বা জীপ যখন ওপরে ওঠে বা নিচে নামে সে দৃশ্যকে দূর থেকে দেখলে মনে আনন্দের সাথে ভয়েরও উদ্রেক ঘটে।কারণ যত উচুতে উঠবেন ততই মেঘে ঢাকা পড়বে। ফলে অনেক সময় পাহাড়ের চূড়া বা রাস্তা দেখা যায় না।মনে হয় এই বুঝি রাস্তা শেষ!
এ পাহাড়ের চারপাশে বিভিন্ন উপজাতি সম্প্রদায় বাস করছে এবং তাদের বৈচিত্র্যময় জীবনযাত্রারও আপনার নজড় কাড়বে।
৬/ শৈল প্রপাত:
বান্দরবান জেলা কিসের জন্য বিখ্যাত? শৈল প্রপাত নামক জলপ্রপাত বা ঝর্ণার জন্যও বান্দরবানকে আমরা বিখ্যাত বলতে পারি।কারণ এটি একটি চমৎকার স্থান।বর্ষাকালে এ ঝর্ণার প্রবাহ প্রবল হয়ে ওঠে।
তাছাড়া এই ঝর্ণার পানি এতই শীতল এবং স্বচ্ছ যে একে কেন্দ্র করে আশে পাশে দু-তিনটি গ্রাম গড়ে উঠেছে। যা স্থানীয় সম্প্রদায়ের জন্য পানীয় জল ব্যবহারের একটি ভাল উৎস।
স্থানীয় লোকদের হস্তশিল্প, তাঁত পণ্য এবং খাবার নিয়ে শৈল প্রপাতের কাছে একটি ছোট বাজার গড়ে উঠেছে । এই ঝর্ণা দেখার সাথে পাশের গ্রামগুলিও দেখতে যাবেন।তাদের সংগ্রামী জীবনধারা কাছ থেকে দেখলে আপনি উপভোগ করবেন।
৭/ সাঙ্গু নদী:
সাঙ্গু নদী বাংলাদেশের বান্দরবানের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের আরেকটি বিখ্যাত অংশ।সর্পিল আকৃতির এ পাহাড়ি নদী হাজার বছর ধরে পাহাড়ের উপর দিয়ে বয়ে চলেছে ।এ নদীর নির্মল স্বচ্ছ পানির সৌন্দর্য উপভোগ করতে চাইলে নদীতে চালিত ইন্জিন নৌকা বা বোটের করে নদীতে ঘুরতে পারবেন।
৮/ স্বর্ণ মন্দির:
বান্দরবান আর কিসের জন্য বিখ্যাত? আমি বলব বান্দরবান স্বর্ণমন্দিরের জন্য বিখ্যাত।এখানে এসে স্বর্ণমন্দির না দেখে পর্যটকদের ভ্রমণ যেন সম্পন্ন হবে না।কারণ এর অপরূপ নির্মাণশৈলি সত্যিই চোখ ধাঁধানো। স্থানীয় বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের জন্য নির্মিত এ মন্দির স্বর্ণনির্মিত না হলেও এর সোনালী রঙ যখন রোদের সাথে মিশে যায় তখন সত্যিই সোনার মত আভা ছড়ায়।এ মন্দির দেখতে দেশ বিদেশের অসংখ্য পর্যটক ও বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীরা আসেন।
স্বর্ণমন্দিরটি বান্দরবান শহরের উপকণ্ঠে পুলপাড়া, বালাঘাটার কাছে পাহাড়ের চূড়ায় অবস্থিত। আর এ পাহাড়ের আরেকটি আকর্ষণ হলো দেবতা পুকুর যেখানকার পানি কখনও শুকিয়ে যায় না।
৯/ নাফাখুম জলপ্রপাত:
পাহাড়ি কন্যা বান্দরবান জেলার আরেক আকর্ষণ নাফাখুম জলপ্রপাত যা বাংলাদেশের অন্যতম সুন্দর জলপ্রপাত এবং ভ্রমণের জন্য একটি চমৎকার জায়গা। বান্দরবানের এই সুন্দর পর্যটন স্পটটি একবার ঘুরে দেখার জন্য প্রতিটি ভ্রমণকারীর একটি ট্যুর প্ল্যান থাকা উচিত এবং তারপরে তারা বারবার সেই ভ্রমণ স্থানটি দেখার জন্য বিশেষ অনুভূতি অনুভব করবে।
পাহাড়ি কন্যা বান্দরবান কিসের জন্য বিখ্যাত? আশা করি এই পুরো আর্টিকেল টি পড়ে তা জানতে পেরেছেন। আসা করি আপনাদের কিছুটা হলেও উপকারে এসেছে। এগুলো ছাড়াও বান্দরবান আরও অনেক কিছুর জন্যই বিখ্যাত। তবে সব বর্ণনা দেওয়া সম্ভব হয়নি। পরে কখনও হয়তো আবার লিখব বাকিগুলো নিয়ে। আমাদের সাথে থাকার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।