হার্ডিঞ্জ ব্রিজ কিসের জন্য বিখ্যাত । হার্ডিঞ্জ ব্রিজ কেন বিখ্যাত

হার্ডিঞ্জ ব্রিজ কিসের জন্য বিখ্যাত । হার্ডিঞ্জ ব্রিজ কেন বিখ্যাত

আপনার স্বাস্থ্য ধর্ম বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি

হার্ডিঞ্জ ব্রিজ কিসের জন্য বিখ্যাত

 

নাম শুনলেই অনেকে বলে দিতে পারেন এই দৃষ্টিনন্দন ব্রিজটি কোন জেলায়। আবার নিজ চোখে না দেখেও অনেকে বলতে পারেন এই ব্রিজের খুটিনাটি। হার্ডিঞ্জ ব্রিজ প্রৌকশল জগতে এ ব্রীজটি অপ্রতিদ্বন্দীভাবে বিখ্যাত এবং ব্রীজের জন্য রিভার ট্রেনিং ব্যবস্থা আছে যা পৃথিবীতে অদ্বিতীয়। এই কারণ গুলোর জন্য হার্ডিঞ্জ ব্রিজ বিখ্যাত।

হার্ডিঞ্জ ব্রিজ কিসের জন্য বিখ্যাত । হার্ডিঞ্জ ব্রিজ কেন বিখ্যাত

 

জনপ্রিয়তার দিক থেকে বলা যায় এই ব্রিজটি দেশের সবচেয়ে আলোচিত ও সমালোচিত একটি ব্রিজ যা কিনা একবার ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছিল ১৯৭১ সালে। সেতুটির নির্মানকাল ১৯০৯-১৯১৫ সাল। সেই থেকে বর্তমান ২০২২ পর্যন্ত ১০৭ বছর চলছে তো চলছেই। তৎকালীন ভাইসরয় লর্ড হার্ডিঞ্জের নামানুসারে ব্রিজটির নাম রাখা হয় হার্ডিঞ্জ ব্রিজ।  ৫৮৯৪ ফুট বা ১.৮ কি:মি: দৈঘ্য এই সেতুতে দুইটি ব্রডগেজ রেল লাইন শুরু থেকেই সচল করা হয়।

হার্ডিঞ্জ ব্রিজ কোন জেলায় অবস্থিত

পাবনা জেলার ঈশ্বরদী উপজেলার পাকশী নদী প্রান্ত থেকে কুষ্টিয়া জেলার ভেড়ামারা উপজেলার নদীপ্রান্ত পর্যন্ত এই সেতুটির অবস্থান। ১৯০৯ খরোস্রোতা পদ্মার বুক চিড়ে বিশাল এই সেতুটি নির্মাণের দায়িত্ব গ্রহণ করেন ব্রিটিশ প্রকৌশলী স্যার রবার্ট গেইলস । ২৪ হাজার শ্রমিক দীর্ঘ ৬ বছর অক্লান্ত পরিশ্রম করে ১৯১৫ খ্রিষ্টাব্দে সেতুটির নির্মাণ কাজের ইতি টানতে সক্ষম হন। চলুন তাহলে জেনে নেয় যাক “হার্ডিঞ্জ ব্রিজ কিসের জন্য বিখ্যাত”।

১৯৭১ সালে যুদ্ধের সময় ১২ নাম্বার পিলারের যে ক্ষতি হয়েছিলো তা যুদ্ধপরবর্তী সময়ে সংস্কার করা হয়। 

হার্ডিঞ্জ ব্রিজ

 

এই ব্রিজ নির্মানের উদ্দেশ্য

অবিভক্ত ভারত সরকারের ইচ্ছায় ১৮৮৯ খ্রিষ্টাব্দে অসম, ত্রিপুরা, নাগাল্যান্ড ও উত্তরবঙ্গের সঙ্গে কলকাতার সকল যোগাযোগ সহজ করতেই মূলত প্রমত্ত পদ্মার বুকে ব্রিজ নির্মাণের প্রস্তাব করা হয়।

১৫ টি স্প্যানের উপর দাড়িয়ে থাকা এই হার্ডিঞ্জ ব্রিজ কিসের জন্য বিখ্যাত তা নতুন করে বলার কিছু নেই। সে সময়ে রেল যোগাযোগের উপরই মানুষের একমাত্র ভরসা থাকায় এই সেতু নির্মানের পরিকল্পনা নেয় হয়। দেশের উত্তরবঙ্গ আর দক্ষিনবঙ্গের রেল যোগাযোগের ক্ষেত্রে এই সেতুটি তখন থেকেই ভূমিকা পালন করে আসছে। যা কিনা এই দুই অঞ্চলের ব্যবসায়িক সমৃদ্ধিতেও অনেক অবদান রেখে চলেছে।

শৈল্পিক কারুকার্যে ভরপুর এ সেতু শুধু সেতুই নয় বরং বাংলাদেশের ইতিহাস ও ঐতিহ্যের ধারক ও বাহক হয়ে শতবর্ষ পার করে আজও মাথা উচু করে টিকে আছে লাল রঙা এই স্থাপনাটি। ১০০ বছর পেরিয়ে গেলেও এখনো পর্যন্ত দর্শনার্থীদের মন আকৃষ্ট করে চলেছে সেতুটি। এছাড়া এই ব্রিজটির ঠিক পাশ দিয়েই ২০০৪ সালে তৈরি করা হয়েছে একটি সড়কসেতু যা কুষ্টিয়া জেলার বিখ্যাত সাধক ফকির লালন শাহের নামানুসারে লালন শাহ সেতু নামে পরিচিয় বহন করছে। পাশাপাশি দুইটি সেতু পদ্মার বুকের ঐতিহ্য আর অপরূপ সৌন্দর্যে মিলেমিশে একাকার হয়ে রয়েছে।

বর্ষায় সেতুর মূল চিত্র ফুটে উঠে। দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে পর্যটকরা এসে ভিড় জমায় পদ্মার বুক চেড়া এই সৌন্দর্য দর্শনে। নৌকা ভ্রমণ থেকে শুরু করে আনন্দ উল্লাসে মাতিয়ে রাখে সেতুটির আসেপাশের অঞ্চলকে। অপরূপ সৌন্দর্য উপলব্ধি করতে করতে কবি লেখেন কবিতা, বাউল তার কন্ঠে মাতিয়ে তোলেন ভাটিয়ালী সুরের গান। এছাড়া প্রতি বছরের বিভিন্ন সময়েও  বিদেশি পর্যটকদেরও আনাগোনা দেখা যায় এই স্থানে। নির্মাণের ১০৭ বছর পার হয়ে গেলেও উপমহাদেশের ঐতিহ্যবাহী এই হার্ডিঞ্জ ব্রিজ স্বচক্ষে দেখার কৌতূহল যেন সব মানুষের মনেই রয়ে গেছে।

হার্ডিঞ্জ ব্রীজের মূল নকশা

এই ব্রিজটি মূল নকশার অনুমোদন পায় ১৯০৮ সালে। এরপর ব্রীজের মূল নকশা প্রণয়ন করেন স্যার এস এম বেনডেলেগ। ব্রীজটির প্রথম প্রকল্প প্রণয়ন করেন স্যার ফ্রান্সিস সপ্রীং। ব্রীজ ঠিকাদার ছিলেন ব্রেইথ ওয়াইট এন্ড কার্ক।

 

গাইড ব্যাংক নির্মাণ

১৯০৯ সালে প্রমত্ত পদ্মার ওপর ব্রীজ নির্মাণের জরিপ কাজ শুরু হলেও ১৯১০ ও ১১ সালে প্রথম কাজের মৌসুম শুরুর সময় আগ্রাসি পদ্মার দুই তীরে ব্রীজরক্ষী বাঁধ নির্মাণের প্রয়োজনীয়তা দেখা দিলে পরে ১৯১২ সালে ব্রীজটিকে গাইড ব্যাংক নির্মাণ শুরু করে।

ব্রীজের স্থান পরিবর্তন

প্রথমে হার্ডিঞ্জ ব্রীজের কাজ শুরু হয়েছিল বর্তমান ব্রীজ যেখানে অবস্থিত সেখান থেকে প্রায় ১ কিলোমিটার দক্ষিণে। বেশ কিছু কাজ হওয়ার পরে অজানা কারণে ব্রিজের স্থান পরিবর্তন করে উত্তর দিকে ব্রীজ নির্মাণ কাজ শুরু করে পূর্বের নির্ধারিত জায়গাতেই।

কূপ খনন

১৯১২ সালে প্রমত্তা পদ্মার স্রোতকে পরাজিত করে ৫টি কূপ খনন করা হয়। ১৯১৩ সালে আরো ৭টি কূপ খনন করা হয়।

স্প্যান

মোট ১৫টি স্প্যান গড়ে তোলা হয়। যার প্রতিটির বিয়ারিংদ্বয়ের মধ্যবর্তী দৈর্ঘ্য ৩শ ৪৫ ফুট দেড় ইঞ্চি এবং উচ্চতা ছিলো ৫২ ফুট। প্রতিটি স্প্যানের ওজন ১ হাজার ২শ ৫০ টন। রেল লাইনসহ ১ হাজার ৩শ টন, ব্রীজটিতে মোট ১৫টি স্প্যান ছাড়াও দুই পাড়ে ৭৫ করে ৩টি অতিরিক্ত ল্যান্ড স্প্যান রয়েছে। এদের প্রতি দু’টি বিয়ারিংদ্বয়ের মধ্যবর্তী দৈর্ঘ্য ৭৫ ফুট। ক

শ্রমিক সংখ্যা

এই হার্ডিঞ্জ ব্রিজ প্রকল্পটিতে কর্মী সংখ্যা ছিলো মোট ২৪ হাজার ৪শ। দীর্ঘ ৫ বছর অক্লান্ত পরিশ্রমের পর ১৯১৫ সালে ব্রীজের কাজ শেষ হয়েছে বলে রেল বিভাগ সূত্রে জানা যায়।

যা যা করতে হয়েছে

ব্রীজ নির্মাণের ব্রীজ রক্ষা বাঁধের জন্য মাটির কাজের পরিমাণ দুই পার্শ্বের লাইনের ১৬ কোটি ঘনফুট। মোট ইটের গাথুনির কাজ হয় ২ লাখ ৯৯ হাজার টন। মোট ইস্পাত ব্যবহৃত হয় ৩০ লাখ টন। মোট সিমেন্ট ব্যবহৃত হয় ১ লাখ ৭০ হাজার ড্রাম। কিলডসিমেন্ট লাগানো হয় ১২ লাখ ড্রাম।

ব্রিজের মোট ব্যয়

তৎকালীন হিসেবে ব্রীজটি তৈরী করতে ব্যয় হয় অনেক টাকা। স্প্যানের জন্য ১ কোটি ৮০ লাখ ৬ হাজার ৭শ ৯৬ টাকা। ল্যান্ড স্প্যান স্থাপনের জন্য ৫ লাখ ১৯ হাজার ৮শ ৪৯ টাকা। নদীর গতি নিয়ন্ত্রণের জন্য ৯৪ লাখ ৮ হাজার ৩শ ৪৬ টাকা। দুই পাশের রেল লাইনের জন্য ৭১ লাখ ৫৫ হাজার ১শ ৭৩ টাকা। ব্রীজটি নির্মাণ করতে তৎকালীন টাকা সর্বমোট ৩ কোটি ৫১ লাখ ৩২ হাজার ১শ ৬৪ টাকা খরচ হয় ব্রীজ পুনঃ নির্মাণ ব্যয়। এখনকার সময় সীমিত টাকা হলেও ঐ সময় টাকার অনেক মান ছিল এ তথ্য রেলের পাকশী ডিবিশন থেকে জানা গেছে।

হার্ডিঞ্জ ব্রিজ কেন বিখ্যাত

উল্লেখিত কয়েকটি পরিসংখ্যান বিশ্লেষণ করলে জানা যায়, প্রকল্পটির ব্যাপক বড় ও বিখ্যাত তার নিজ যোগ্যতায়। বর্তমানে হার্ডিঞ্জ ব্রীজের চেয়েও লম্ব ও দৃষ্টিনন্দন সেতু অনেক রয়েছে। কিন্তু দু’টি কারণে প্রৌকশল জগতে এ ব্রীজটি অপ্রতিদ্বন্দীভাবে বিখ্যাত। প্রথম কারণ হচ্ছে এ ব্রীজের ভিত গভীরতম পানির সর্বনিম্ন সীমা থেকে ১৬০ ফুট বা ১৯২ এমএসএল মার্লির নিচে। উল্লেখ্য, ১৫ নম্বর ব্রীজ স্তম্ভের কুয়া স্থাপিত হয়েছে পানি নিম্নসীমা থেকে ১শ ৫৯ দশমিক ৬০ ফুট নিচে এবং সর্বোচ্চ সীমা থেকে ১শ ৯০ দশমিক ৬০ ফুট অর্থ্যাৎ সমুদ্রের গড় উচ্চতা থেকে ১শ ৪০ ফুট নীচে। সে সময় পৃথীবিতে এ ধরনের ভিত্তির মধ্যেই এটাই ছিল গভিরতম। বাদ বাকি ১৪টি কুয়া বসানো হয়েছে ১৫০ ফুট মাটির নিচে। দ্বিতীয় কারণ হচ্ছে এ ব্রীজের জন্য রিভার ট্রেনিং ব্যবস্থা আছে তাও পৃথিবীতে অদ্বিতীয়। 

বর্তমান হার্ডিঞ্জ ব্রীজের নিচে আর নেই পদ্মার সেই গভীরতা, নেই প্রমত্ত পদ্মার গর্জে ওঠার শব্দ। পদ্মার বুক জুড়ে জেগে উঠেছে ছোট বড় বালুর চর। পাকশীর হাডিঞ্জ ব্রীজ কালের স্বাক্ষি হয়ে দাঁড়িয়ে আছে বাংলার অনেক গল্প নিয়ে।

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *