জামালপুর জেলা কিসের জন্য বিখ্যাত
জামালপুর বাংলাদেশের ময়মনসিংহ বিভাগে অবস্থিত একটি প্রশাসনিক জেলা। বুড়িগঙ্গা নদীর পশ্চিম তীরে অবস্থিত জামালপুর বাংলাদেশের অন্যতম একটি বাণিজ্যিক এলাকা। বিশেষ করে পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের সাথে আমদানি ও রপ্তানির অন্যতম বাণিজ্য কেন্দ্র জামালপুর।
বিভিন্ন ফসল ফলাদি, যেমন: ধান, গম,আলু,পাট, সরিষা ইত্যাদি উৎপাদনে বাংলাদেশের শীর্ষে জামালপুর।
জামালপুরে রয়েছে একটি গৌরবময় ইতিহাস ও ঐতিহ্য। বাংলাদেশের বিশেষ কিছু ব্যক্তিত্বের জন্মস্থান, খাবার পাবার ও দর্শনীয় স্থানের জন্য বিখ্যাত জামালপুর।
জামালপুর জেলা সম্পর্কে তথ্য
আয়তনের দিক দিয়ে জামালপুর জেলা বাংলাদেশের ১৮তম বৃহৎ জেলা। এটির মোট আয়তন ৭৮৪ বর্গমাইল। বসবাসকারী মোট জনসংখ্যা ২৩৮৪৮৮১ জন। অর্থাৎ প্রতি বর্গ কিলোমিটারে বসবাসকারী গড় জনসংখ্যা ১২০০ জন।
সাক্ষরতার হার প্রায় ৩৮.৫%। সেক্ষেত্রে সাক্ষরতার হারের দিক দিয়ে বেশ পিছিয়ে থাকবে জামালপুর জেলা। জামালপুর জেলার পূর্ব নাম সিংহজানি।
জামালপুর জেলা ইতিহাস
ইতিহাস বিশ্লেষণ করে জানা যায় সম্রাট আকবরের সময়কালে ইয়েমেন থেকে হযরত শাহ জামাল রহমাতুল্লাহ আলাইহি নামের একজন ধর্ম প্রচারক এসেছিলেন তৎকালীন সিংহজানিতে।
তার সাথে এসেছিল প্রায় ২০০ জন অনুসারী যাদের অধিকাংশের বসতি ছিল ইয়েমেনে। এমনকি হযরত শাহ জামাল রহমাতুল্লাহ আলাইহি নিজেও জন্মগ্রহণ করেছিলেন ইয়েমেনে। হযরত কামাল রাহমাতুল্লাহ আলাইহি- এর চারিত্রিক গুণাবলীতে মুগ্ধ হয়ে সেখানকার মানুষ ঝাকে ঝাকে ইসলাম গ্রহণ করতে থাকে। এবং এক পর্যায়ে নিম্নবর্গীয়-হিন্দুত্বসিত জামালপুরে মুসলিম সংখ্যা বৃদ্ধি পেতে থাকে।
১৯৭১ সালের ১০ই ডিসেম্বর জামালপুর জেলা পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর হাত থেকে মুক্ত হয়। ১৯৭৮ সালে এটি ময়মনসিংহ জেলা থেকে আলাদা হয়ে একটি স্বাধীন জেলায় পরিণত হয়। পরবর্তীতে ১৯৮৪ সালে জামালপুর ভেঙ্গে গিয়ে শেরপুর নামের একটি জেলা গঠিত হয়।
জামালপুর জেলার নামকরণ করা হয় হযরত শাহ জামাল রহমাতুলি আলাইহি এর নামানুসারে।
জামালপুর জেলা কিসের জন্য বিখ্যাত
আর্টিকেলের এই পর্যায়ে আমরা জানতে চলেছি জামালপুর জেলা কিসের জন্য বিখ্যাত সে সম্পর্কে!
মূলত জামালপুর বাংলাদেশের অন্যতম বাণিজ্যকেন্দ্র হওয়ার কারণে সারা বাংলাদেশে বিখ্যাত। বুড়িগঙ্গা নদীর তীরে অবস্থিত হওয়ার কারণে জামালপুরে পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের সাথে পণ্য রপ্তানি অথবা আমদানি করা হয়ে থাকে জামালপুর থেকে।
জামালপুরে বেশ কয়েকটি মিষ্টির দোকান রয়েছে যেগুলো সমগ্র বাংলাদেশের বিখ্যাত। এখানকার পায়েস অনেক বিখ্যাত।
জামালপুরে বুড়ির মিষ্টির দোকান নামের একটি মিষ্টির দোকান রয়েছে। এখানকার ক্ষির,পায়েস,রাবড়ির সুনাম রয়েছে বহুদূর দিয়ে।
কাঁসার বাসন-কোসন তৈরির জন্য জামালপুর বেশ বিখ্যাত। এছাড়াও জামালপুরে খাঁটি তামা দিয়ে বিভিন্ন স্বর্ণালংকার তৈরি হয়ে থাকে। তার পাশাপাশি তৈরি করা হয় থালা বাটি বাসন-কোসন। জামালপুরের নন্দীপাল পান অনেক বিখ্যাত। জামালপুরে বেশ কয়েকটি ছোটখাটো চিনিকল গড়ে উঠেছে। যদিও ব্যবসায়িক লোকসানের কারণে সেগুলো আজ বন্ধের মুখে প্রায়।
বাংলাদেশের দেশবরেণ্য ব্যক্তিত্বের জন্য জামালপুর জেলা বেশ বিখ্যাত। জামালপুরে অনেক মুক্তিযোদ্ধা রয়েছে। যাদের মধ্যে অনেকেই খেতাব-প্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা।
বুড়িগঙ্গা নদীর পশ্চিমে অবস্থিত জামালপুর নদীবন্দর হিসেবে সর্বাধিক বিখ্যাত, বলতে গেলে অন্যতম একটি ব্যস্ত নগরী।
জামালপুরের বিখ্যাত খাবার
জামালপুর বাহারি রকমের খাবারের জন্য বিখ্যাত। জামালপুরের মিল্লি নামের একটি ঐতিহ্যবাহী খাবার বেশি জনপ্রিয়। এটি মূলত মাত্রাতিরিক্ত মসলাযুক্ত গরুর নিহারী ।
সাধারণত বিয়ে বাড়িতে, মৃত বাড়ির মিলাদ মাহফিলে অথবা সুন্নতে খাতনার অনুষ্ঠানের অন্যতম আইটেম মিল্লি।
জামালপুরের সরিষা বাড়ির ক্ষীরের পায়েস বেশ বিখ্যাত। এছাড়াও বুড়ির দোকানের নানান মিষ্টান্নের খ্যাতি ছড়িয়ে রয়েছে সমগ্র বাংলাদেশে।
এছাড়াও জামালপুরের নান্দীপালের পান বেশ বিখ্যাত পান প্রেমীদের কাছে।
জামালপুরের প্রত্যেকটি অলিতে গলিতে মিষ্টির দোকান রয়েছে। এই সকল মিষ্টির দোকানের মূল আকর্ষণ ছানার পায়েস।
জামালপুর বিখ্যাত ব্যক্তি
খালিদ মোশাররফ
বীর উত্তম খেতাবপ্রাপ্ত সাহসী মুক্তিযোদ্ধা এবং বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক।
আব্দুস সালাম
বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের সাবেক মহাসচিব এবং বাংলাদেশের অন্যতম রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব।
আনোয়ার হোসেন
বাংলার মুকুট বিহীন নবাব খেতা প্রাপ্ত চলচ্চিত্র শিল্পী আনোয়ার হোসেনের জন্ম জামালপুর জেলায়। বাংলাদেশের চলচ্চিত্র প্রেমি প্রত্যেকটি প্রজন্মের কাছে তিনি পরিচিত। সুতরাং এখন নিশ্চয়ই বলার অপেক্ষা রাখে না জামালপুর জেলা কিসের জন্য বিখ্যাত।
আব্দুল করিম
বাংলাদেশের সাবেক স্পিকার এবং বিশিষ্ট রাজনীতিবিদ।
মরহুম আনোয়ার উল্লাহ
একজন ভাষা সৈনিক। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনে তিনি পুলিশের গুলিতে নিহত হন।
জামালপুর জেলার বিখ্যাত স্থান বা দর্শনীয় স্থান
জামালপুর জেলার বিখ্যাত বা দর্শনীয় স্থানগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো:
মালঞ্চ মসজিদ
একি জামালপুর জেলা শহরের একটি মডেল মসজিদ। ধারণা করা হয়ে থাকে আদি মালঞ্চ মসজিদের রূপকার ছিলেন হযরত শাহ জামাল রহমাতুল্লা আলাইহি এর এক অনুসারী হযরত ইবনে আব্বাস (র)।
তবে পরবর্তীতে কোন এক অজানা কারণে মসজিদ দীর্ঘকাল সংস্কারের অভাবে ক্ষয়প্রাপ্ত হতে থাকে। পরবর্তীতে ১৯৬১ সালে মসজিদটি সংস্কার করা হয়। এবং এলাকার নাম অনুসারে মসজিদে নামকরণ করা হয় মালঞ্চ মসজিদ।
আধুনিকতা ও নান্দনিকতার মিশ্রনে মালঞ্চ মসজিদকে নতুনভাবে সাজানো হয়েছে। সে কারণে বর্তমানে এটি অন্যতম একটি পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে পরিচিত।
দয়াময়ী মন্দির
শুধু জামালপুর নয় বরং সমগ্র ময়মনসিংহ জেলার হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের কাছে এই মন্দিরটি অন্যতম একটি ধর্মালয়। ১৫৬১ সালে এই মসজিদটি গড়ে উঠেছিল ।
দুর্গাপূজা এই মন্দিরের অন্যতম আকর্ষণ। হিন্দু মুসলমান নির্বিশেষে সকলেই অসাধারণ কারুকার্য দেখার জন্য ভির জমায় দয়াময়ী মন্দিরে।
হযরত শাহ জামাল রঃ এর মাজার
যেমনটা কি আমরা আর্টিকেলের শুরুতে বলেছি যে সম্রাট আকবরের সময়কালে হযরত শাহ জামাল রহমতুল্লাহ আলাইহি ইয়েমেন থেকে বাংলাদেশে এসেছিলেন ধর্ম প্রচারের উদ্দেশ্যে । তিনি জামালপুরে ইন্তেকাল করেন এবং এখানেই তাকে দাফন করা হয়।
জামালপুর সদরের চাপতলি ঘাট সংলগ্ন তার মাজারটি অবস্থিত। অত্যন্ত নান্দনিক কারো কার্যতে সাজানো হয়েছে মাজারটির মূল ফটক। অনেকেই নিজেদের ধর্মীয় বিশ্বাস থেকে শাহজামাল রহমাতুল্লা আলাইহি এর মাজারে যথাসাধ্য দান করে থাকেন। তাদের বিশ্বাস এতে তাদের মনস্কামনা পূর্ণ হবে এবং সৃষ্টিকর্তা তাদের হেফাজত করবেন।
আমাদের আজকের আর্টিকেলের মূল আলোচ্য বিষয় ছিল জামালপুর জেলা কিসের জন্য বিখ্যাত সে সম্পর্কে। ছোট্ট এই বাংলাদেশের ৬৪ টি জেলার ৬৪ রকমের বৈশিষ্ট্য। তবে ইতিহাস,ঐতিহ্য,ঐতিহাসিক ঘটনার প্রেক্ষাপট,বিশেষ ব্যক্তিত্ব এবং রসনা-বিলাসের জন্য জামালপুর অনন্য ।