নেত্রকোনা কিসের জন্য বিখ্যাত
নেত্রকোনা কিসের জন্য বিখ্যাত? নেত্রকোনা বাংলাদেশের মধ্যাঅঞ্চলে বর্তমান ময়মনসিংহ বিভাগে অবস্থিত একটি জেলা ।৬২৯ খ্রিস্টাব্দে হিন্দুরা যা শশাঙ্ক চৈনিক পরিব্রাজক হিউ এন সাংকে সর্বপ্রথম এখানে আমন্ত্রণ করেন । ১৮৮০ সালে ব্রিটিশ শাসনামলে সর্বপ্রথম বারের মতো এটিকে মহাকুমার স্বীকৃতি প্রদান করা হয়। পরবর্তীতে ১৯৮৪ সালে প্রয়াত প্রেসিডেন্ট হোসেন মোহাম্মদ এরশাদের সময়কালে এটিকে জেলায় পরিণত করা হয় ।
পূর্বে এটি ঢাকা এবং পরবর্তীতে সিলেট বিভাগের অন্তর্গত হলেও, বর্তমানে এটি ময়মনসিংহ বিভাগের অন্তর্ভুক্ত ।
মূলত আজকের আর্টিকেলে আমরা আলোচনা করতে চলেছি নেত্রকোনা কিসের জন্য বিখ্যাত সেই সম্পর্কে । ( Netrokona Kiser Jonno Bikkhato )
নেত্রকোনা জেলার ইতিহাস
সপ্তম শতকের সর্বপ্রথম বারের মতো হিউয়েন সাং নামের একজন চৈনিক পড়িব্রাজক নেত্রকোনা জেলা আবিষ্কার করেন। পরবর্তীতে এই জেলার শাসন ওভার গ্রহণ করেছিল নারায়ণ বংশীয় কুমার ভাস্কর বর্মন।
ত্রয়দশ শতাব্দীর দিকে এই অঞ্চলটি সম্পূর্ণ রাজত্ব ছাড়া হয়ে পড়ে এবং তৎকালীন বৈশ্য গারো দুর্গা গারোরা স্বাধীনভাবে এই অঞ্চলটি শাসন করতে থাকে । তবে পরবর্তীতে, পঞ্চম শতাব্দীতে আলাউদ্দিন হোসেন শাহ এর আমলে এটি পুনরায় মুসলিম শাসনাধীন হয়ে পড়ে। এবং পর্যায়ক্রমে মুসলমান শাসকদের হাতবদল হতে থাকে ।
সর্বশেষ সম্রাট জাহাঙ্গীরের রাজত্বকালে নেত্রকোনা সহ সমস্ত ময়মনসিংহ মোগল সাম্রাজ্য ভুক্ত হয় এবং সেখানে মুসলিম গভর্নর নিয়োগ দেওয়া হয় ।
পরবর্তীতে ব্রিটিশ আমলে ১৮৮০ সালের দিকে এটি একটি মহকুমায় পরিণত হয়। ১৯৮৪ সালে তৎকালীন স্বৈরাচার শাসক হোসেন মোহাম্মদ এরশাদ এটিকে জেলায় পরিণত করেন।
মূলত নেত্রকোনা নামটি এসেছে “নাটের কোনা” নামক একটি গ্রাম থেকে। মূলত এই গ্রামটি ও নেত্রকোনা জেলার অন্তর্ভুক্ত ।
উনিশ শতকের দিকে টিপু পাগলা নামের একজন তথাকথিত মানসিক ভারসাম্যহীন রোগী ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে পাগলপন্থী বিদ্রোহ নামের একটি বিদ্রোহের ডাক দেয়। এবং এই পাগলপন্থী বিদ্রোহ নির্মূলের উদ্দেশ্যে তৎকালীন ব্রিটিশ সরকার “নাটের কোনা” নামের একটি প্রশাসনিক কেন্দ্র স্থাপন করেছিল।
এরপর বিবর্তিত হতে হতে জায়গাটির নাম নেত্রকোনায় পরিণত হয় ।
নেত্রকোনা কিসের জন্য বিখ্যাত
মূলত নেত্রকোনার বিখ্যাত হওয়ার বেশ কিছু কারণ রয়েছে । মূলত নেত্রকোনা জেলা বালিশ মিষ্টির জন্য বিখ্যাত দেশ জুড়ে। এছাড়াও বিশেষ ব্যক্তিত্ব, দর্শনীয় স্থান এবং খাবার দাবার কৃষ্টি কালচার ইত্যাদি সবকিছু মিলিয়ে নেত্রকোনা গোটা বাংলাদেশের ভেতরে বেশ খ্যাতিমান ও বিখ্যাত একটি জেলা ।
নেত্রকোনা জেলার বিখ্যাত ব্যক্তিবর্গ
নেত্রকোনা জেলায় বাংলাদেশের বিভিন্ন দেশবরেণ্য ব্যক্তিবর্গের জন্ম হয়েছে । এবং এর সংখ্যা প্রায় ২০০ এর উপরে হবে । যাদের মধ্যে অন্যতম হলো:
-
নির্মলেন্দু গুণ: তিনি একজন বিশিষ্ট কবি ও সাহিত্যিক। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও অসাম্প্রতিক চেতনা নিয়ে তিনি তার কবিতা রচনা করে গিয়েছেন ।
-
হুমায়ূন আহমেদ: নন্দিত কথা সাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদ জন্মগ্রহণ করেন ১৯৪৮ সালে নেত্রকোনা জেলায় ।
-
ডঃ মুহাম্মদ জাফর ইকবাল: বিখ্যাত শিশু কিশোর সাহিত্যিক ও শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক ডঃ মুহাম্মদ জাফর ইকবাল জন্মগ্রহণ করেন এই নেত্রকোনা জেলায় ।
-
বিচারপতি শাহাবুদ্দিন আহমেদ: বাংলাদেশের রাজনীতির এক অবিচ্ছেদ অংশ বিচারপতি শাহাবুদ্দিন আহমেদ জন্ম গ্রহণ করেছিলেন এই নেত্রকোনা জেলায় ।
-
মনসুর বয়াতি: কালজয়ী এই শিল্পীর হাত ধরে গড়ে উঠেছে ময়মনসিংহ গীতিকা। যেটি সমগ্র বাংলা পেরিয়ে সারা বিশ্বে সুখ্যাতি অর্জনের মাধ্যমে বাংলা সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করেছে ।
এছাড়ায় নেত্রকোনা আরো বেশ কয়েকজন বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গের জন্য বিখ্যাত । সুতরাং নেত্রকোনা কিসের জন্য বিখ্যাত তা হয়তো অনুমান করতে পারছেন ।
নেত্রকোনা জেলার দর্শনীয় স্থান
প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ও বিভিন্ন ঐতিহাসিক ঘটনার সাক্ষী বাংলাদেশের নেত্রকোনা জেলা । এখানে রয়েছে চিনামাটির পাহাড় । নান্দনিক সৌন্দর্য মন্ডিত চিনামাটির পাহাড়ে এলে আপনার মনে হবে জানো বাংলাদেশ নয় পৃথিবীর অন্য কোন সৌন্দর্যমণ্ডিত দেশে ঢুকে পড়েছেন ।
এছাড়াও রয়েছে ডিঙ্গাপোতা হাওর । শুকনো মৌসুমের যখন ডিঙ্গাপোতা হাওর এর পানির মাত্রা কমে আসে,তখন দুপাশে জেগে উঠে চর। ইচরে ধান গম সহ
নেত্রকোনার দুর্গাপুর নামের একটি উপজেলা রয়েছে। এটি সম্পূর্ণটাই মূলত আদিবাসী অধ্যুষিত এলাকা । এই এলাকার পাশ দিয়ে বয়ে গিয়েছে সোমেশ্বরী নামের একটি নদী । তারপর দু পাশে রয়েছে অপূর্ব সৌন্দর্য মন্ডিত পাহাড় ।
নেত্রকোনা জেলায় রয়েছে উপজাতীয় কালচার একাডেমি। এখানে মূলত নেত্রকোনায় অবস্থিত উপজাতিদের বিভিন্ন সংস্কৃতিক পরিচয় বহনকারী বস্তু যেমন পোশাক অস্ত্রপাতি ব্যবহৃত সরঞ্জামাদি ইত্যাদি সংরক্ষণ করা হয়।
দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে মানুষ ছুটে এসে কেবল এই জিনিসগুলো দেখার জন্য। এটি নেত্রকোনা জেলার দুর্গাপুর উপজেলায় অবস্থিত। এবং যেমনটা কি আগেও বললাম এটি মূলত আদিবাসী অধ্যুষিত একটি এলাকা।
এছাড়াও কমলকান্ত উপজেলায় রয়েছে সাত শহীদের মাজার। মূলত এখানে মহান মুক্তিযুদ্ধের শহীদ সাতজন বীর মুক্তিযোদ্ধাকে একসাথে গণকবর দেওয়া হয়েছিল।
এটি ভারত বাংলাদেশ সীমান্তে অবস্থিত। তার পাশেই রয়েছে কমলকান্ত মসজিদ।
মসজিদের অসাধারণ কারু-কার্য যে কাউকে মুগ্ধ করবে৷ কিছুদিন পূর্বেও এই মসজিদটির আকর্ষণ বৃদ্ধি করার জন্য মসজিদটি নতুনভাবে সংস্কার করা হয়েছে । এবং এর ফলে মসজিদটি সৌন্দর্য আরও দ্বিগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে।
নেত্রকোনা জেলার বিখ্যাত খাবার
নেত্রকোনার সবচেয়ে বিখ্যাত খাবার হল বালিশ মিষ্টি । এটি শুধু বাংলাদেশ নয় পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে এ সুস্বাদু মিষ্টান্ন তৈরীর প্রচলন রয়েছে। বিশেষ করে আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের পশ্চিমবঙ্গে বালিশ মিষ্টির প্রচলন বহুদিন থেকেই। তবে সেখানে মূলত এটিকে ল্যাংচা নামে ডাকা হয়।
নেত্রকোনার খাবার বালিশ মিষ্টির বিশেষত্ব হলো এটি অনেক মিহি, নরম ও তুলতুলে।
প্রথমে দুধের ছানা বালিশের আকৃতি করে সেটিতে পর্যাপ্ত পরিমাণে চিনি মিশিয়ে ঘিয়ে ভেজে নিতে হয় ।
এরপর সেগুলো চিনির শিরার মধ্যে ভেজালেই হয়ে যাবে বালিশ মিষ্টি।
এছাড়াও এই মিষ্টি গয়নাতের বালিশ নামে পরিচিত ।
নেত্রকোনায় আরো একটি খাবার বিশেষভাবে সমাদৃত। সেটি হলো চ্যাপা মাছের শুটকি। চ্যাপা মাছের শুটকি খেতে হলে আপনাকে একবার হলেও নেত্রকোনায় আসতেই হবে। কেননা জানা যায় এই শুটকি মাছ রান্না করার জন্য যেসব মসলার প্রয়োজন পড়বে সেগুলি কেবলমাত্র নেত্রকোনার আবহাওয়াতেই ফলে ।
বালিশ মিষ্টি ছাড়াও জিলাপি,পান্তুয়া, গরুর নেহারি, নিমকি ইত্যাদি খাবারের জন্য প্রসিদ্ধ নেত্রকোনা ।
আজকের আর্টিকেলে আমরা জেনেছি,নেত্রকোনা কিসের জন্য বিখ্যাত, নেত্রকোনা জেলার ইতিহাস,নেত্রকোনা জেলার বিখ্যাত খাবার,নেত্রকোনা জেলার বিখ্যাত ব্যক্তিবর্গ,নেত্রকোনা জেলার দর্শনীয় স্থান সম্পর্কে।
আজকে এই আর্টিকেল থেকে আপনারা নেত্রকোনা কিসের জন্য বিখ্যাত তা বুঝতে পেরেছেন। আসা করি আপনাদের আর্টিকেলটি ভালো লেগেছে। আমাদের সাথে থাকার জন্য ধন্যবাদ।