জয়পুরহাট জেলা কিসের জন্য বিখ্যাত ?
জয়পুরহাট বাংলাদেশের উত্তর-পশ্চিম অঞ্চলে অবস্থিত একটি প্রশাসনিক অঞ্চল। ভৌগোলিক অবস্থানগত কারণে জয়পুরহাট বাংলাদেশের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি জেলা। জয়পুরহাট ভারতের সীমান্তে অবস্থিত হওয়ার কারণে এটি অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ একটি অঞ্চল।
জয়পুরহাটের ইতিহাস পড়ায় কয়েকশো বছরের পুরনো। এবং আজকের আর্টিকেলে আমরা জানতে চলেছি জয়পুরহাট জেলা কিসের জন্য বিখ্যাত সেই সম্পর্কে।
চলুন বিস্তারিত জেনে নেওয়া যাক…
জয়পুরহাট কোথায় অবস্থিত- জয়পুরহাট এর অবস্থান
জয়পুরহাট বাংলাদেশের উত্তর পশ্চিমে অবস্থিত রাজশাহী বিভাগের একটি প্রশাসনিক অঞ্চল। এই জেলার পূর্বে অবস্থিত বগুড়া জেলা ও গাইবান্ধা,পশ্চিমে নওগাঁ ও ভারত সীমান্ত, দক্ষিনে বগুড়া জেলা এবং উত্তরায় গাইবান্ধা জেলা।
জয়পুরহাট জেলার ইতিহাস
জয়পুরহাট জেলার বেশ বড় একটি ইতিহাস রয়েছে। চলন্ত সংক্ষেপে জেনে নেওয়া যাক:
১৮২১ সালে রাজশাহী, রংপুর,দিনাজপুর জেলার বেশ কয়েকটি থানা মিলে বগুড়া জেলা গঠিত হয়েছিল। সেই সময় জয়পুরহাট ছিল বগুড়া জেলার একটি থানা।
১৮৫৭ সালে বাংলায় প্রচন্ড রকমের দুর্ভিক্ষ দেখা দিলে জয়পুরহাটে বহু মানুষ মারা যায়।
পরবর্তীতে ব্রিটিশ পিরিয়ডে জয়পুরহাটে একটি রেল স্টেশন গড়ে তোলা হয়। ধীরে ধীরে সেখানে বৃদ্ধশালী ব্যক্তিরা অবস্থান করতে শুরু করে এবং তাদের জনবসতি গড়ে তোলে ।
পরবর্তীতে ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার পূর্বে জয়পুরহাটকে একটি মহকুমা উন্নীত করা হয়।
১৯৭১ সালে জয়পুরহাট ৭ নম্বর সেক্টরের অধীনে ছিল। ১৯৭১ সালের ১১ ডিসেম্বর জয়পুরহাটে অবস্থিত হিলি অঞ্চল শত্রু মুক্ত হওয়ার মাধ্যমে সমগ্র জয়পুরহাট শত্রুমুক্ত হয়।
১৯৮৪ সালের ২৬শে ফেব্রুয়ারি প্রয়াত রাষ্ট্রপতি হোসেন মোহাম্মদ এরশাদ এর সময়কালে জয়পুরহাটকে একটি জেলায় উন্নীত করা হয়।
জয়পুরহাট জেলা কিসের জন্য বিখ্যাত
একটি জেলা মূলত বিখ্যাত হয়ে থাকে সে জেলায় জন্মগ্রহণকারী বিশেষ ব্যক্তিত্ব, খাবার ও দর্শনীয় স্থানের জন্য।
তবে নির্দিষ্টভাবে বলতে গেলে জয়পুরহাট মূল ত বিখ্যাত এখানে উৎপাদিত ফসলের জন্য। যেমন ধান, ডাল,আলু, ইক্ষু,কলা,লতিরাজ ইত্যাদি।
এছাড়া জয়পুরহাটের চটপটি খুবই বিখ্যাত। এখানে হরেক রকমের ডাল চাষ হয়।
জয়পুরহাটের বিখ্যাত খাবার
আপনি বিশ্বাস করুন বা না করুন অধিকাংশ ক্ষেত্রে যেগুলোকে আমরা স্ট্রীটফুড ভেবে থাকি জয়পুরহাটে সেগুলো অত্যন্ত বিখ্যাত এবং ঐতিহ্যবাহী বটে।
জয়পুরহাটের প্রত্যেকটি অলিতে গলিতে দেখা মিলবে ছোট বড় চটপটির দোকান । তবে এটি বিশেষ কেননা- বেশ কয়েক প্রকার মসলার কম্বিনেশনে তৈরি করা হয় এ মুখস্ত খাবার। এছাড়াও জয়পুরহাটে চটপটির দোকানগুলোতে বিশেষ মসলা ব্যবহার করা হয় যার ভেতরে লুকিয়ে থাকে এই অনন্য স্বাদ।
জয়পুরহাটে যে কয়েকটি চটপটির দোকান রয়েছে তার মধ্যে অন্নপূর্ণা চটপটি,ফুচকা এন্ড কফি হাউস অন্যতম।
জয়পুরহাটে প্রচুর পরিমানে অরহর ডাল চাষ করা হয়। যেটি চটপটি তৈরির মূল উপকরণ। এটি অনেকের কাছে ডাবলি ডাল পরিচিত ।তবে অনেকে মটরশুটি দিয়ে তৈরি করে থাকেন।
এছাড়া জয়পুরহাটে রয়েছে ঐতিহ্যবাহী বিসমিল্লাহ হোটেল । এখনকার গরুর মাংস ভুনা ও বিফ চপ বেশ বিখ্যাত। যদিও স্বাদ প্রসঙ্গে ভিন্ন আলাপ।
জয়পুরহাটে রয়েছে বিখ্যাত শর্মা মিষ্টির দোকান। এবং এখানকার হাড়িভাঙ্গা মিষ্টি খেতে চাইলে অবশ্যই আপনাকে একবার হলেও আসতে হবে।
জয়পুরহাট দর্শনীয় স্থান
জয়পুরহাটে দর্শনীয় স্থানগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো:
পাগলা দেওয়ান বধ্যভূমি:
১৯৭১ সালে ১৪ ই ডিসেম্বর জয়পুরহাট জেলার চকবড়ত ইউনিয়নে পাকিস্তান হানাদার বাহিনী কর্তৃক একটি জঘন্য ও পৈশাচিক গণহত্যার আয়োজন করা হয়েছিল। সেই গণহত্যায় যাদেরকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয় তাদেরকে সেই ইউনিয়নে অবস্থিত পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর ক্যাম্পে গণকবর দেওয়া হয়, আনুমানিক ১২২ জন নিরীহ গ্রামবাসীকে।
মূলত সেখানেই গড়ে উঠেছে পাগলা দেওয়ান বধ্যভূমি। প্রতিবছরের বধ্যভূমি দেখতে আসেন লাখো পর্যটক।
লকমা রাজবাড়ী:
এটি জয়পুরহাট জেলার পাঁচবিবি উপজেলায় অবস্থিত। ভারতের সীমান্তবর্তী অঞ্চলে অবস্থিত এ রাজবাড়ীটি মূলত একটি ঐতিহাসিক প্রত্নতাত্ত্বিক এলাকা।
ধারণা করা হয় এক সময় লকমা রাজবংশের বসবাস ছিল এখানে। যদিও কালের বিবর্তনে এখন এটিই সম্পূর্ণটাই ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে। সংস্কার করা হয়নি বিধায় জন্মেছে আগাছা।
হিন্দা কসবা শাহী জামে মসজিদ:
এটি বাংলাদেশের জয়পুরহাটে অবস্থিত সবচেয়ে বড় জামে মসজিদ। তান্দনিক শিল্প কলায় সুসজ্জিত মসজিদটি শুধু একটি ধর্মালয় নয় বরং একটি পর্যটন কেন্দ্র। ধারণা করা হয়ে থাকে আজ থেকে আনুমানিক ৭৫০ বছর পূর্বে খলিফা আব্দুল খালেক চিশতীর তত্ত্বাবধ্ধনের নির্মাণ করা হয়েছিল এই মসজিদটি।
মসজিদটির পাশেই মোট চারজন সুফি সাধকের মাজার রয়েছে।
নান্দাইল দিঘি:
একটু জয়পুরহাট জেলার কালাই উপজেলায় অবস্থিত।
যদিও মৌর্য শাসন অনেক আগেই বিলুপ্ত হয়ে গিয়েছিল তবে বাংলায় জয়পুরহাটে ১৬ শতকেও মৌর্য শাসন চলছিল। বিষয়টি অবাক করার মতো হলেও এটি ছিল আইন বহির্ভূত শাসন। তবে সেখানকার রাজারা ছিলেন যথেষ্ট জনহিতোষী।
১৬১০ সালে এমনই একজন মৌর্য সম্রাট নন্দলাল অত্র এলাকার চাষীদের শুকনো মৌসুমের চাষাবাদের কথা চিন্তা করে একটু দিঘী খনন করেন যার নামকরণ করা হয় নন্দলাল দিঘী। তবে পরবর্তীতে অপভ্রংশ জনিত কারণে এটির নামকরণ করা হয় নান্দাইল দিঘী।
জয়পুরহাট জেলার বিখ্যাত ব্যক্তি
স্বাধীনতা পরবর্তীকালীন সময় জরিপ থেকে দেখা যায় জয়পুরহাটে মোট মুক্তিযুদ্ধ সংখ্যা ৭৩৯ জন। জয়পুরহাটের বিখ্যাত ব্যক্তিদের মধ্যে রয়েছে:
কবি আতাউর রহমান:
একজন ভাষা সৈনিক ও বাংলা একাডেমী সাহিত্য পুরস্কারপ্রাপ্ত কবি । তিনি ১৯২৭ সালে জয়পুরহাটে জন্মগ্রহণ করেন। জীবনের অধিকাংশ সময় তিনি শিক্ষকতা পেশার সাথে জড়িত ছিলেন।
মশিউর রহমান:
তিনি ১৯২৪ সালে জয়পুরহাট জেলায় জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ছিলেন বাংলাদেশের সাবেক মন্ত্রী এবং প্রখ্যাত রাজনীতিবিদ।
মশিউর রহমান মাওলানা ভাষাণীর অন্যতম একজন শীর্ষ ছিলেন এবং তার রাজনৈতিক চিন্তাধারা অনেকটাই আয়ত্ত করতে পেরেছিলেন। ১৯৭৬ সালের পরবর্তী সময়ে তিনি বাংলাদেশ ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির সভাপতি হিসেবে নিযুক্ত হন। জিয়াউর রহমানের শাসনামলে তিনি প্রধানমন্ত্রীর মর্যাদার একজন সিনিয়র মন্ত্রী হিসেবে নিযুক্ত ছিলেন ।
খুরশিদ আলম:
খুরশিদ আলম বাংলাদেশের একজন প্লেব্যাক গায়ক। তার গানগুলোর মধ্যে সবচেয়ে জনপ্রিয় গানটি হল “চুমকি চলছে একা পথে”।
দিলরুবা খানম:
দিলরুবা খারামের পিতা সৈয়দ হামিদুর রহমান রংপুর বেতারের একজন জনপ্রিয় শিল্পী হলেও তিনি চাননি তার সন্তান শিল্পী হোক।
তবে সংস্কৃতি মনা পরিবার থেকে উঠে আসার কারণে পরবর্তীতে দিলরুবা দেশ বরেণ্য একজন শিল্পী হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন।
আমাদের আজকের আর্টিকেলের মূল প্রতিপাদ্য বিষয় ছিল জয়পুরহাট জেলা কিসের জন্য বিখ্যাত সেই সম্পর্কে। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে জয়পুরহাট জেলার গুরুত্ব অসামান্য। এ অঞ্চলের মানুষের আত্মত্যাগ স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে। তার পাশাপাশি ইতিহাস, ঐতিহ্য ও দর্শনীয় স্থান নিয়ে অন্যান্য এই জয়পুরহাট !