চুয়াডাঙ্গা জেলা কিসের জন্য বিখ্যাত
চুয়াডাঙ্গা বাংলাদেশের দক্ষিণ পশ্চিম অঞ্চলে অবস্থিত একটি প্রশাসনিক এলাকা। এটি খুলনা বিভাগের অন্তর্ভুক্ত একটি জেলা। চুয়াডাঙ্গা বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ কিছু ঘটনার জন্য বেশ গুরুত্বপূর্ণ।
এছাড়া চুয়াডাঙ্গা একটি বৃহৎ বাণিজ্য কেন্দ্র। তাই আজকের আর্টিকেলে আমরা জানতে চলেছি, চুয়াডাঙ্গা জেলা কিসের জন্য বিখ্যাত সে সম্পর্কে।
চলুন বিস্তারিত জেনে নেওয়া যাক…
চুয়াডাঙ্গা জেলার ইতিহাস
চুয়াডাঙ্গা জেলার ইতিহাস প্রায় ১০০০ বছরের পুরনো। রাজা শশাঙ্কের আমলে সর্বপ্রথম চুয়াডাঙ্গা জেলা আবিষ্কৃত হয় এবং ধারণা করা হয়। রাজা শশাঙ্ক চুয়াডাঙ্গাকে তার রাজত্বের অন্তর্ভুক্ত করে নেন এবং সেখানে গভর্নর নিযুক্ত করেন।
১৮ শতকে নবাব সিরাজউদ্দৌলার বেপরোয়া শাসনের কারণে সেখানকার সচেতন সমাজ ধারণা করেছিল অতিসত্বর তার পতন ঘটতে চলেছে।
এই আশঙ্কায় অনেকেই চুয়াডাঙ্গা ত্যাগ করে অন্যত্র চলে যান।
১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে চুয়াডাঙ্গা জেলায় অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ন কিছু ঘটনা ঘটে। যুদ্ধ চলাকালীন চুয়াডাঙ্গাতে সর্বপ্রথম কমান্ড বাহিনী গঠন করা হয়।
১৯৭১ সালে ১০ এপ্রিল বাংলাদেশের সর্বপ্রথম অস্থায়ী সরকার মুজিবনগর সরকার গঠন করার পাশাপাশি চুয়াডাঙ্গা কে বাংলাদেশের সর্বপ্রথম অস্থায়ী রাজধানীতে পরিণত করা হয়।
১৯৭১ সালের ২৬শে মার্চ চুয়াডাঙ্গায় আনুষ্ঠানিকভাবে মুক্তিযুদ্ধ কমান্ড গড়ে তোলা হয় এবং ১৯৭১ সালের ৮ ই ডিসেম্বর চুয়াডাঙ্গা হানাদার বাহিনীর হাত থেকে মুক্ত হয়।
১৯৮৪ সালে হোসেন মোহাম্মদ এরশাদের সময়কালে চুয়াডাঙ্গাকে মহাকুমা থেকে চালায় উন্নীত করা হয়।
চুয়াডাঙ্গার নামকরণ
চুয়াডাঙ্গার নামকরণ সম্পর্কে যতদূর জানা গেছে তা হল:
১৩ শতকের দিকে চুয়াডাঙ্গায় মল্লিক রাজবংশের গড়াপত্তন হয়। এই মল্লিক রাজবংশের আদি পিতা ছিল চুঙ্গ। চুঙ্গকে তারা দেবতার মত পূজা করত। ধারণা করা হয় তার নাম অনুসারেই অত্র এলাকার নামকরণ করা হয় চুঙ্গডাঙ্গা।
১৭৯৭ সালের একটি পুরনো ডকুমেন্ট থেকে চুঙ্গডাঙ্গা নামটি আবিষ্কৃত হয়। ধীরে ধীরে অপভ্রংশের প্রভাবে এটির নাম বদলে চুয়াডাঙ্গায় পরিণত হয় ।
চুয়াডাঙ্গা জেলা কিসের জন্য বিখ্যাত?
বাংলাদেশের অস্থায়ী রাজধানী হিসেবে পরিচিত চুয়াডাঙ্গা বেশ কিছু কারণে বিখ্যাত। চুয়াডাঙ্গা জেলায় ব্যাপক পরিমাণে তামাক এবং পান পাতা চাষ করা হয়ে থাকে। যার ফলে চুয়াডাঙ্গা সারা বাংলাদেশে সমাদৃত ও বিখ্যাত।
চুয়াডাঙ্গা জেলায় রয়েছে দর্শনা। যেটি ভারত বাংলাদেশ সীমান্তের নিকট অবস্থিত অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি জায়গায় এবং পর্যটক কেন্দ্র বটে!
ব্রিটিশ শাসন আমল থেকে শুরু করে আজ অব্দি দেশের বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ গণ আন্দোলন গড়ে উঠেছিল চুয়াডাঙ্গা হতে। চুয়াডাঙ্গার মাটিতে চির নিদ্রায় রয়েছেন অনেক ভাষা শহীদ এবং বীর মুক্তিযোদ্ধা।
চুয়াডাঙ্গা জেলার বিখ্যাত খাবার
পান ও তামাক
ভৌগোলিক অবস্থান কত কারণে চুয়াডাঙ্গায় বেশ ভালো পান এবং তামাক উৎপন্ন হয়ে থাকে। এখানে “এ”ক্যাটাগরির তামাক চাষ করা হয় । এখানকার পান পাতা বেশ বিখ্যাত।
কুমড়ি বড়ি
কুমড়া, কলাই ডাল এবং বেশ কয়েক রকমের মসলা একসাথে মিশিয়ে বিশেষ কায়দায় তৈরি করা হয় কুমড়ি বড়ি । শুকতে দেওয়া হয় রোদে, শুকনা হয়ে গেলে তৈরি হয়ে যায় অনন্য স্বাদের কুমড়ি বড়ি।
সাধারণত সবজি এবং মাছের সাথে তরকারি হিসেবে রান্না করা হয়ে থাকে। অনেকে ভেজেও খান। অনন্য স্বাদের এই খাবারটির জন্মস্থান চুয়াডাঙ্গা ।
শীতের সময় চুয়াডাঙ্গার নারীরা কুমড়ি বড়ি তৈরির কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। এটি তাদেরকে আর্থিকভাবে স্বাবলম্বী করে থাকে।
খেজুরের গুড়
চুয়াডাঙ্গার খেজুরের গুড় সারা বাংলাদেশ জুড়ে মশহুর। পাটালি গুড়ের অনন্য স্বাদ পৃথিবীর যে কোন মিষ্টান্ন কে হার মানাবে।
চুয়াডাঙ্গা জেলার বিখ্যাত স্থান
চুয়াডাঙ্গা জেলার দর্শনীয় স্থানগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো:
দর্শনা
চুয়াডাঙ্গা জেলা শহর থেকে ২১ কিলোমিটার পশ্চিমে ভারত বাংলাদেশ সীমান্তে অবস্থিত দর্শনা।
দর্শনা দিয়ে সরাসরি রেল যোগে বাংলাদেশ থেকে ভারত প্রবেশ করা যায় ।রেল লাইনের দুপাশে রয়েছে সবুজ গাছের সারি। দেখতে মনোমুগ্ধকর, তাই এটি বর্তমানে দর্শনীয় স্থান হিসেবে পরিচিত।
ঠাকুরপুর জামে মসজিদ
ঠাকুরপুর জামে মসজিদ চুয়াডাঙ্গার ঠাকুরপুর উপজেলায় অবস্থিত অন্যতম মুসলিম নিদর্শন কলা। আজ থেকে প্রায় ৫০০ বছর আগে মসজিদটি নির্মাণ করা হয়েছিল । কালক্রমে মসজিদটিতে বিভিন্ন কারু কার্য করা হয়েছে, সাথে লেগেছে আধুনিকতার ছোঁয়া ।
কেরু এন্ড কোং
কেরু এন্ড কোং বাংলাদেশের গর্ব। চুয়াডাঙ্গার দর্শনাকে অবস্থিত এই প্রতিষ্ঠানটি ১৯৩৮ সালে গড়ে তোলা হয়েছিল।
বর্তমানে এই প্রতিষ্ঠানে দেশী বিদেশী বিভিন্ন ব্র্যান্ডের মদ তৈরি করা হয়। দেশের চাহিদা পূরণ করে যেগুলো দেশের বাইরেও রপ্তানি করা হয়ে থাকে।
তবে শুধু মত নয় তার পাশাপাশি বিভিন্ন ড্রাগস, প্রতিষেধক, এবং চিনি শিল্পের জন্য পরিচিত কেরু এন্ড কোং।
বর্তমানে, মুনাফার দিক দিয়ে এটি বাংলাদেশের শীর্ষ স্থানীয় একটি প্রতিষ্ঠান।
পুলিশ পার্ক
২০০৬ সালে সাবেক অফিসার ইনচার্জ আব্দুর রহমান নিজ উদ্যোগে গড়ে তুলেছিলেন পুলিশ পার্ক। বর্তমানে বাড়িতে যোগ করা হয়েছে বিভিন্ন ধরনের রাইড এবং আধুনিক সতর্কতা সরঞ্জাম ।
প্রতিবছর দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে অবকাশ যাপনের উদ্দেশ্যে ছুটে আসেন দর্শনার্থীরা।
চুয়াডাঙ্গা জেলার বিখ্যাত ব্যক্তি বর্গ
চুয়াডাঙ্গা জেলায় বাংলাদেশের এমন কিছু বিশেষ ব্যক্তিত্ব জন্ম গ্রহণ করেছেন যাদের অবদান ছিল, ব্রিটিশ ভাগাও অভিযান , রাষ্ট্রভাষার আন্দোলন এবং মহান মুক্তিযুদ্ধে।
তাদের মধ্যে অন্যতম হলেন:
অতুল কুমার সাহা
১৮২১ সালে জন্মগ্রহণকারী অতুল কুমার সাহা ভারতবর্ষ থেকে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে পরিচালিত অভিযানে ছিলেন সোচ্চার।
অমিত কুমার দত্ত
১৯২১ সালে চুয়াডাঙ্গা জন্মগ্রহণ করেছিলেন। তিনিও ছিলেন ব্রিটিশ স্বৈরাচার শাসনের বিরুদ্ধে সোচ্চর। যদিও পরবর্তীতে চলে যান ভারতে।
মিসবাহ উল হক
১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন এবং ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধে অসম্মান ও অবদান রাখেন বেরো উত্তম খেতাবপ্রাপ্ত বীর মুক্তিযোদ্ধা মিসবাহ উল হক।
ফিরোজ বারী মালিক
১৯২৩ সালে জন্মগ্রহণকারী ফিরোজ বারী মালিক ছিলেন বাংলাদেশের একজন বামপন্থী মেধাবী রাজনীতিবিদ। যদিও পরবর্তীতে ডানপন্থী দলে যোগদান করেছিলেন। ১৯৭৬ থেকে ৭৮ সাল পর্যন্ত তৎকালীন সরকারের মন্ত্রী পদমর্যাদার একজন উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্বরত ছিলেন তিনি।
আমাদের আজকের আর্টিকেলের মূল প্রতিপাদ্য বিষয় ছিল চুয়াডাঙ্গা জেলা কিসের জন্য বিখ্যাত সেই সম্পর্কে। চুয়াডাঙ্গার সাথে জড়িয়ে রয়েছে বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধের এক অনন্য ইতিহাস। থেকে কারণে চুয়াডাঙ্গা অনন্য এবং কোটি “বাঙালি হৃদয়ে” জাগ্রত। আসা করি আর্টিকেল টি আপনাদের ভালো লেগেছে। আমাদের সাথে থাকার জন্য ধন্যবাদ।