জেনে নিন পিরোজপুর কিসের জন্য বিখ্যাত
পিরোজপুর বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলে অবস্থিত বরিশাল বিভাগের অন্তর্ভুক্ত একটি এ ক্যাটাগরির প্রশাসনিক এলাকা। ভৌগলিক সীমানার কারণে পিরোজপুর অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি জেলা।
পিরোজপুর কিসের জন্য বিখ্যাত |
এবং আজকের আর্টিকেলে আমরা আলোচনা করতে চলেছি পিরোজপুর কিসের জন্য বিখ্যাত সে সম্পর্কে। তার পাশাপাশি জানবো পিরোজপুর জেলার ইতিহাস, বিখ্যাত খাবার, বিখ্যাত ব্যক্তিত্ব,দর্শনীয় স্থান এবং পিরোজপুর জেলার কিছু গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব বিস্তারকারী নদী সম্পর্কে।
পিরোজপুর জেলার ইতিহাস
পিরোজপুর জেলা মূলত গড়ে উঠেছে বঙ্গোপসাগরের ঔরসজাত জোয়ার ভাটার কারণে। এটি বাংলাদেশের নিষ্ক্রিয় বদ্বীপ অঞ্চলে অবস্থিত, এবং উপকূলীয় প্লাবনভূমি।
ধারণা করা হয় সুলতানি আমলের মুসলিম শাসক ফিরোজ শাহ এর নাম অনুসারে এই অঞ্চলের নামকরণ করা হয়েছিল ফিরোজপুর। পরবর্তীতে এটি ফিরোজপুর থেকে পিরোজপুর হিসেবে পরিচিতি লাভ করে।
সম্রাট আকবরের সময় কালে এই অঞ্চলটি লবণ উৎপাদনের জন্য উৎকৃষ্ট ছিল। ১৯৮৪ সালে মহাকুমা গুলোকে জেলায় উন্নীত করা হলে পিরোজপুর একটি পূর্ণাঙ্গায় পরিণত হয়।
সেই সময় পিরোজপুর মোট সাতটি উপজেলার ৬৪৫টি গ্রাম নিয়ে একটি পূর্ণাঙ্গ জেলা হিসেবে গড়ে ওঠে।
পিরোজপুর কিসের জন্য বিখ্যাত
আবহমানকাল থেকে পিরোজপুরে ঐতিহ্যবাহী সংস্কৃতির চর্চা হয়ে থাকে। মূলত এটি পিরোজপুরের বিখ্যাত হওয়ার অন্যতম একটি কারণ।
বিভিন্ন ধরনের প্রবাদ প্রবচন এবং বিয়ের গান উৎপত্তি লাভ করেছে পিরোজপুর থেকে। যেগুলো বর্তমানে সারা বাংলার মানুষের কাছে বিশেষভাবে সমাদৃত।
এছাড়াও পিরোজপুর জেলা সুপারি পেয়ারা নারিকেল আমরা ইত্যাদি ফলের জন্য বিখ্যাত।
পিরোজপুর থিয়েটার এবং কৃষ্ণচূড়া থিয়েটার সংস্কৃতি মনা মানুষ করতে এক অনন্য অবদান রেখেছে। এছাড়া পিরোজপুরে বিখ্যাত একটি রসগোল্লা তৈরি হয়ে থাকে। যেটি পিরোজপুরের ঐতিহ্যবাহী একটি খাবার ।
পিরোজপুরের বিখ্যাত খাবার
পিরোজপুরের মানুষ বেশ ভজনরসিক হওয়ার সুবাদে এখানে বেশ কিছু রেস্তোরা গড়ে উঠেছে যেখানে পিরোজপুরের ঐতিহ্যবাহী খাবার গুলো বিক্রি হয়ে থাকে।
তবে বৃহস্পর মূলত সুপারি নারিকেল পেয়ারা আমড়া ইত্যাদি ফলের প্রতুলতার কারণে বেশ জনপ্রিয়। পিরোজপুর জেলা শহরের অলিতে গলিতে গড়ে উঠেছে ছোটখাটো মিষ্টির দোকান।
তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো দুলালের দধি ভান্ডার এখানকার রসমালাই দধি ও রসগোল্লা বেশি জনপ্রিয়।
পিরোজপুর জেলা শহরের পুরনো বাসস্ট্যান্ডে বাস কাউন্টারের পাশে বেশ কয়েকটি চিতই পিঠার দোকান এক সারিতে দেখতে পাওয়া যায়। এখানকার ব্যবসায়ীরা হরদম সেগুলো বিক্রি করে এবং সেগুলো বেশ সমাদৃত বটে।
পিরোজপুরের খাবারের দোকান গুলোর মধ্যে অন্যতম হলো আইসক্রিম ভান্ডার। এখানে বিশেষ মসলা ব্যবহার করে পুড়ি তৈরি করা হয়। আলু পুরি, ডাল পুরি সবই বিক্রি হয় এই দোকানে। প্রতিটি পুরি বিক্রি হয় মাত্র ৫ টাকায় !
যদিও ঐতিহ্যবাহী এই পুরির অমায়িক স্বাদ উপভোগ করতে হলে আপনাকে সকাল থেকে লাইন দিয়ে থাকতে হবে।
রসগোল্লা আমাদের অনেকেরই একটি প্রিয় মিষ্টান্ন। তবে রসগোল্লার উৎপত্তিস্থল নিয়ে বেশ দ্বিধাদ্বন্দ্ব রয়েছে। অনেকে মনে করে থাকেন পশ্চিমবঙ্গের নদীয়া জেলার ফুলিয়ার হারাধন ময়রা আদি রসগোল্লার উদ্ভাবক। তবে অনেকের মতে কলকাতার নবীনচন্দ্র দাস নামের একজন ময়রা সর্বপ্রথম আধুনিক রসগোল্লা আবিষ্কার করেন। যেটিকে তিনি নামকরণ করেছিলেন স্পন্স রসগোল্লা নামে। এবার নিশ্চয়ই পাঠকেরা উপলব্ধি করতে পেরেছেন পিরোজপুর কিসের জন্য বিখ্যাত !
তবে বিশেষজ্ঞদের মতে রসগোল্লার আদি উৎপত্তিস্থল বাংলাদেশের পিরোজপুর । পিরোজপুরের রসগোল্লা নিয়ে সাহিত্যিক সৈয়দ মুজতবা আলী রসগোল্লা নামের একটি রম্য গল্প লিখেছিলেন।
পিরোজপুর জেলার বিখ্যাত ব্যক্তি
পিরোজপুর জেলার বিখ্যাত ব্যক্তিবর্গদের মধ্যে রয়েছেন:
খান বাহাদুর হাসান আলী খান:
খান বাহাদুর হাসেম আলী খান ছিলেন শেরেবাংলা একে ফজলুল হকের মন্ত্রিসভার কৃষি খাতক মন্ত্রী। এছাড়াও তিনি বরিশাল জেলার মুসলিম লীগ এবং কৃষক প্রজা পার্টির সভাপতির পদ লাভ করেছিলেন।
শহীদ নূর হোসেন:
তিনি ছিলেন একজন রাজনৈতিক কর্মী। ১৯৮৭ সালে দশই নভেম্বর স্বৈরাচারী শাসক প্রয়াত রাষ্ট্রপতি হোসেন মোহাম্মদ এরশাদের এর বিরুদ্ধে পরিচালিত অভ্যুত্থানে তিনি তার পিঠে “স্বৈরাচার নিপাত যাক,গণতন্ত্র মুক্তি পাক” লিখেছিলেন। রাজধানীর জিরো পয়েন্টে বর্তমান মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার গাড়ির সামনে তাকে গুলি করে হত্যা করা হয়।
জুয়েল আইচ:
তিনি বাংলাদেশের একজন খ্যাতিমান জাদু শিল্পী।
খালিদ হাসান মিলু:
জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত একজন কণ্ঠশিল্পী।
শাহরিয়ার নাফিস:
বাংলাদেশের অন্যতম খ্যাতিমান ওপেনিং ব্যাটসম্যান।
জান্নাতুল ফেরদৌস ঐশী:
২০১৮ সালের মিস বাংলাদেশ প্রতিযোগিতায় তিনি বিজয়ী হন এবং পরবর্তীতে, মিস ওয়ার্ল্ড এর মত বিশ্ব আসরে তিনি সর্বপ্রথম বারের মতো একজন বাংলাদেশী হিসেবে শীর্ষ-২০ এ অবস্থান করেন।
জায়েদ খান:
তিনি বিশ্বব্যাপী সমাদৃত বাংলাদেশের খ্যাতিমান সফল চলচ্চিত্র শিল্পী।
পিরোজপুরের দর্শনীয় স্থান
ভাসমান পেয়ারা বাজার
পিরোজপুর জেলা শহর থেকে প্রায় ১৫ কিলোমিটার দূরে ভিমরুলী গ্রামে আঁকা বাঁকা নদীগুলোতে পেয়ারার ভাসমান বাজার বসে। প্রতিবছরের ভাসমান বাজারের আকর্ষণ উপভোগ করতে অনেকে ছুটে আসেন পিরোজপুর।
রায়ের কাঠি জমিদার বাড়ি
আজ থেকে প্রায় ৩৫০ বছর আগে এই জমিদার বাড়িটি নির্মাণ করা হয়েছিল। এই রাজ বাড়িতে রয়েছে অতিথিশালা, নহবত খানা এবং নাট্যশালা সহ আরো অনেক কিছু।
রিভারভিউ ইকোপার্ক
পিরোজপুরের বলেশ্বরী নদীর তীরে অবস্থিত রিভারভিউ ইকোপার্ক। এটি স্থানীয়দের কাছে ডিসি পার্ক নামে পরিচিত। এই ইকোপার্ক থেকে দেখা মিলবে বলেশ্বর নদীর অপরূপ সৌন্দর্য।
সারেংকাঠি পিকনিক স্পট
এটি একটি অসাধারণ পিকনিক স্পট। গ্রাম্য প্রাকৃতিক পরিবেশ এবং গাছ গাছালিতে ভরা এই অসাধারণ পিকনিক স্পটটি বনভোজনের জন্য উপযুক্ত।
পিরোজপুর জেলার নদী
ভৌগলিক সীমানার প্রভাবে পিরোজপুর জেলার উপর দিয়ে বিভিন্ন নদনদী বয়ে গেছে। যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল কালিগঙ্গা,কোচাখালী,বালেশ্বর,মধুমতি ইত্যাদি।
প্রতিবছর নদী ভাঙ্গনের ফলে পিরোজপুরের মানুষ ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। প্রতিবছর বিপর্যয়ের শিকার হতে হয় পিরোজপুরের সাধারণ মানুষকে।
বিশেষ করে পিরোজপুর জেলার ভেতর দিয়ে প্রবাহিত হওয়া কালিগঙ্গা,সন্ধ্যা,বালেশ্বর ইত্যাদি নদী বেশ গুরুতরভাবে এই অঞ্চলকে প্লাবিত করে।
বিশেষ করে বর্ষাকালে তীব্রতা আরও বেশি বৃদ্ধি পায়। যার ফলে জেলে এবং মৃৎশিল্পের সাথে সংশ্লিষ্ট মানুষজন সহ হাজারো পরিবার ভূমিহীন হয়ে পড়ে।
বিগত কয়েক বছরে ইয়াস এবং আমফান এর মত ঘূর্ণিঝড়ের দ্বারা পিরোজপুরের মানুষ সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
আমাদের আজকের আর্টিকেলের মূল প্রতিপাদ্য বিষয় ছিল পিরোজপুর কিসের জন্য বিখ্যাত সে সম্পর্কে। ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে পিরোজপুর বেশ গুরুত্বপূর্ণ একটি। দুর্ভাগ্যের বিষয় এখনো সেই এলাকার মানুষের জীবনমানের খুব একটা উন্নতি ঘটেনি।
তবে প্রাকৃতিক নৌস্বর্গ, খ্যাতিমান ব্যক্তিত্ব, খাবার দাবার ঐতিহ্য, সংস্কৃতি এবং দর্শনীয় স্থানের কারণে পিরোজপুর দেশজুড়ে খ্যাতিমান !